ইসলামে জেনা (ব্যভিচার) হলো অবৈধ যৌন সম্পর্ক

ইসলামে জেনা (ব্যভিচার) হলো অবৈধ যৌন সম্পর্ক, যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। জেনা মূলত দুই প্রকারের হতে পারে:

জেনা আল-মুহসান (বিবাহিতদের জেনা)

জেনা আল-মুহসান বলতে ইসলামে বিবাহিত ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত ব্যভিচার বা অবৈধ যৌন সম্পর্ককে বোঝানো হয়। এটি ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ এবং এর শাস্তি কঠোরভাবে নির্ধারিত হয়েছে। এই শাস্তির মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজে শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা বজায় রাখা, পরিবারিক বন্ধন ও সামাজিক শুদ্ধতা রক্ষা করা।

জেনা আল-মুহসানের সংজ্ঞা:

  • যদি কোনো বিবাহিত পুরুষ বা নারী স্বামী বা স্ত্রীর বাইরে অন্য কারো সাথে অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে, তবে সেটিকে জেনা আল-মুহসান বলা হয়।

শাস্তি:

  • ইসলামে বিবাহিতদের দ্বারা সংঘটিত জেনার শাস্তি হল রজম, অর্থাৎ পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড। এটি সরাসরি ইসলামের শাস্তির বিধানের অন্তর্ভুক্ত, যা প্রাথমিকভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর যুগে কার্যকর করা হয়েছিল।

হাদিসে জেনা আল-মুহসানের শাস্তি:

১. রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“কোনো বিবাহিত পুরুষ বা নারী যদি জেনা করে, তবে তাদের শাস্তি হলো পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড।”
(বুখারি, হাদিস নং ৬৮২৯)

২. হজরত ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
“রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড” (রজম) হলো সেই ব্যক্তির জন্য যিনি বিবাহিত এবং জেনা করেছেন।'”
(মুসলিম, হাদিস নং ১৬৯০)

প্রক্রিয়া:

  • রজম বা পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড তখনই কার্যকর হবে যখন চারজন বিশ্বস্ত সাক্ষী অপরাধের প্রত্যক্ষদর্শী হবেন অথবা অপরাধী নিজে স্বীকার করবে।

তাওবা ও ক্ষমা:

যদিও ইসলামে জেনার শাস্তি কঠোর, তবে কোনো অপরাধী যদি আন্তরিকভাবে তাওবা (অনুশোচনা) করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করতে পারেন। তাওবা করলে মৃত্যুর পর আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি মাফ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

উদ্দেশ্য:

জেনা আল-মুহসানের কঠোর শাস্তি সমাজে অবৈধ সম্পর্ক রোধ করতে এবং ও সামাজিক শুদ্ধতা বজায় রাখতে নির্ধারিত হয়েছে।

আরও পড়ুন: নামাজের সুন্নত

জেনা আল-ঘাইর মুহসান (অবিবাহিতদের জেনা)

জেনা আল-ঘাইর মুহসান বলতে অবিবাহিত পুরুষ বা নারীদের দ্বারা সংঘটিত ব্যভিচার বা অবৈধ যৌন সম্পর্ককে বোঝানো হয়। ইসলামে এটিও গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত, তবে বিবাহিতদের জেনার তুলনায় এর শাস্তি তুলনামূলকভাবে কম, কারণ বিবাহিতদের সাথে তুলনায় অবিবাহিতরা এমন সম্পর্ক থেকে দূরে থাকার আরও সুযোগ পেতে পারে।

শাস্তি:

জেনা আল-ঘাইর মুহসানের শাস্তি কুরআন এবং হাদিসে স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে:

  1. কুরআনের নির্দেশনা:
    “ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত করো, এবং আল্লাহর বিধান কার্যকর করতে তাদের শাস্তি দিতে গিয়ে তোমাদের মনে দয়া যেন স্থান না পায়, যদি তোমরা আল্লাহ এবং শেষ দিবসে বিশ্বাসী হও।”
    (সূরা আন-নুর, আয়াত ২)
  2. হাদিসে শাস্তি:
    “অবিবাহিতদের জন্য জেনার শাস্তি হলো ১০০ বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন।”
    (মুসলিম, হাদিস নং ১৬৯০)

শাস্তির প্রক্রিয়া:

  • শাস্তি কার্যকর করার আগে, অপরাধ প্রমাণ করতে হবে চারজন বিশ্বস্ত সাক্ষীর মাধ্যমে, যারা অপরাধটি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে। এ ছাড়া, অপরাধী নিজে অপরাধ স্বীকার করলেও শাস্তি কার্যকর হবে।
  • শাস্তি শুধুমাত্র শরিয়াহ ভিত্তিক আদালতে এবং ইসলামি শাসনব্যবস্থায় নির্ধারিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্যকর করা যেতে পারে।

তাওবা ও ক্ষমা:

ইসলামে যেকোনো পাপ থেকে তাওবা করার মাধ্যমে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি সত্যিকারভাবে আল্লাহর কাছে তাওবা করে এবং ভবিষ্যতে এই পাপ থেকে বিরত থাকার প্রতিজ্ঞা করে, তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন।

উদ্দেশ্য:

জেনা আল-ঘাইর মুহসানের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে সমাজের নৈতিকতা বজায় রাখতে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করতে।

চোখের জেনা

চোখের জেনা হলো এমন দৃষ্টি যা অবৈধ বা হারাম কোনো কিছুর দিকে তাকানোকে বোঝায়, বিশেষত এমন কিছু যা যৌন উত্তেজনা বা অশ্লীল চিন্তা সৃষ্টি করতে পারে। ইসলামে চোখের জেনাও একটি পাপ হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ এটি হারাম কাজের দিকে মানুষকে প্রলুব্ধ করতে পারে। কুরআন ও হাদিসে চোখের জেনা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কুরআনে চোখের জেনা সম্পর্কিত নির্দেশ:

১. সূরা আন-নূর, আয়াত ৩০:
“মুমিন পুরুষদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাজত করে”। এটাই তাদের জন্য অধিকতর পবিত্র। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ে সম্যক অবহিত।”
(সূরা আন-নূর, আয়াত ৩০)

২. সূরা আন-নূর, আয়াত ৩১:
“এবং মুমিন নারীদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাজত করে।”
(সূরা আন-নূর, আয়াত ৩১)

হাদিসে চোখের জেনা সম্পর্কে:

১. আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“চোখের জেনা হল হারাম কিছু দেখা, কানের জেনা হল হারাম কিছু শোনা, জিহ্বার জেনা হল হারাম কথা বলা, এবং হাতের জেনা হল হারাম কিছু স্পর্শ করা। এবং শেষ পর্যন্ত, যোনি তা নিশ্চিত করে বা তা অস্বীকার করে।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৬৫৭)

২. জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ করে হারাম কিছু দেখলে আমার কি করা উচিত? তখন তিনি বললেন:
“তুমি তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবে।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২১৫৯)

চোখের জেনা থেকে বিরত থাকার উপায়:

  • দৃষ্টি সংযত করা: একজন মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে।
  • আল্লাহর ভয়: সর্বদা আল্লাহর প্রতি খেয়াল রাখা এবং তার নির্দেশ মেনে চলা।
  • তাওবা: যদি কখনো চোখের জেনা ঘটে, তবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং ভবিষ্যতে তা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করা।

উপসংহার:

চোখের জেনা ইসলামে নিষিদ্ধ কারণ এটি মানুষের অন্তরে খারাপ চিন্তা ও ইচ্ছা সৃষ্টি করতে পারে, যা হারাম কাজের দিকে ধাবিত করে। তাই ইসলামে দৃষ্টি সংযত করার প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে, যাতে সমাজে নৈতিকতা ও পবিত্রতা বজায় থাকে।

আরও পড়ুন: ইসলামে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব

মনের জেনা

মনের জেনা বলতে এমন অবৈধ বা হারাম চিন্তা বা কল্পনা বোঝায়, যা মানুষকে গুনাহ বা পাপের দিকে ধাবিত করতে পারে। যদিও মনের জেনা সরাসরি শারীরিক জেনার মতো শাস্তিযোগ্য নয়, তবে এটি ইসলামের দৃষ্টিতে পাপের সূচনা হিসেবে বিবেচিত। ইসলামে মানুষকে তার মনের খারাপ চিন্তা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, কারণ খারাপ চিন্তা অনেক সময় মানুষকে শারীরিকভাবে পাপ করার দিকে ধাবিত করে।

হাদিসে মনের জেনা সম্পর্কিত বর্ণনা:

১. আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“আদম সন্তানের জন্য তার জেনার অংশ নির্ধারিত হয়েছে, যা সে অবশ্যই করবে। চোখের জেনা হলো হারাম কিছু দেখা, কানের জেনা হলো হারাম কিছু শোনা, মুখের জেনা হলো হারাম কথা বলা, হাতের জেনা হলো হারাম কিছু স্পর্শ করা, পায়ের জেনা হলো হারাম কাজের দিকে যাওয়া। আর মনের জেনা হলো (অবৈধ সম্পর্কের) আকাঙ্ক্ষা এবং কামনা করা, এরপর যোনি তা সত্যে পরিণত করে বা তা অস্বীকার করে।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৬৫৭)

২. হজরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতের জন্য তাদের মনের মধ্যে যে খারাপ চিন্তা আসে, তা থেকে ক্ষমা করেছেন, যতক্ষণ না তারা তা কাজে পরিণত করে বা মুখে প্রকাশ করে।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৬৬৬৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১২৭)

মনের জেনার প্রভাব ও প্রতিকার:

  • আল্লাহর ভয় ও সচেতনতা: মনের খারাপ চিন্তা থেকে বাঁচতে আল্লাহর ভয় মনের মধ্যে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিনিয়ত আল্লাহকে স্মরণ এবং তার আদেশ মানার চেষ্টা করা উচিত।
  • দৃষ্টিকে সংযত করা: চোখের জেনা থেকে বিরত থাকা, কারণ দৃষ্টি অনেক সময় মনের পাপের দিকে ধাবিত করে।
  • তাওবা করা: যদি কেউ মনের মধ্যে খারাপ চিন্তা রাখে, তবে দ্রুত আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।

মনের জেনা বা খারাপ চিন্তা ইসলামে নিষিদ্ধ, কারণ এটি শারীরিক জেনার পথপ্রদর্শক হতে পারে। ইসলামে অন্তরের পবিত্রতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ খারাপ চিন্তা পাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

আরও পড়ুন

ওযরগ্রস্ত, অসুস্থ ব্যক্তি ও মুসাফিরের জন্য নামাজের বিধান
আয়াতুল কুরসি পড়ার বিশেষ ফজিলত ও উপকারিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *