ইমাম বুখারি (রহ.)

ইমাম বুখারি (রহ.)প্রধান হাদিস বিশেষজ্ঞ ও আলেম।

ইমাম বুখারি (রহ.) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম প্রধান হাদিস বিশেষজ্ঞ ও আলেম। তাঁর পুরো নাম মুহাম্মাদ বিন ইসমাইল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরাহ বিন বারদিযবাহ। আরবি ও ফারসি ভাষায় তাঁর নাম محمد بن اسماعيل بن ابراهيم بن مغيره بن بردزبه البخاری। তিনি অত্যন্ত সম্মানিত ও প্রভাবশালী হাদিস সংকলক হিসেবে মুসলিম বিশ্বের কাছে পরিচিত। তিনি “সহীহ বুখারি” নামে একটি বিশুদ্ধ হাদিসের সংকলন রচনা করেন, যা মুসলিমদের নিকট দ্বিতীয় সর্বাধিক বিশুদ্ধ ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত এবং গ্রহণযোগ্য।

ইমাম বুখারীর জন্মনাম ছিল মুহাম্মদ, এবং তাঁর উপনাম ছিল আবু আবদুল্লাহ। তাঁর অসাধারণ হাদিস জ্ঞান ও বিশুদ্ধ সংকলনের জন্য তাঁকে “আমিরুল মুমিনীন ফিল হাদিস” (হাদিসের মধ্যে মুমিনদের নেতা) উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তাঁর জন্মস্থান বুখারা (বর্তমান উজবেকিস্তানে অবস্থিত) হওয়ায় তাঁকে ইমাম বুখারি বলা হয়।

ইমাম বুখারী (রহ.)-এর রচিত সহিহ বুখারি গ্রন্থটি ইসলামী জ্ঞানে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে রেখেছে এবং হাদিসের ক্ষেত্রে এটি সর্বাধিক বিশুদ্ধ উৎস হিসেবে স্বীকৃত।

আমিরুল মুমিনীন ফিল হাদিস
মুহাম্মদ বিন ইসমাইল আল-বুখারী
محمد بن إسماعيل البخاري
ইমাম বুখারীর নামের আরবি চারুলিপি
ইমাম বুখারীর নামের আরবি চারুলিপি
উপাধিআমিরুল মুমিনিন ফিল হাদিস (হাদিস বর্ণনায় মুমিনদের নেতা), হাফিজুল হুজ্জা
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম১৯ জুলাই ৮১০
১৩ শাওয়াল ১৯৪ হিজরী[১]


মৃত্যু১ সেপ্টেম্বর ৮৭০ (বয়স ৬০)
১ শাওয়াল ২৫৬ হিজরী (৬২ বছর)[২]
খরতঙ্গ, সমরকন্দ, আব্বাসীয় খিলাফত
ধর্মইসলাম
জাতিসত্তাতুর্কি/পারসিক
ধর্মীয় মতবিশ্বাসস্বতন্ত্র মুজতাহিদ[৩]
প্রধান আগ্রহহাদিসশাস্ত্র
উল্লেখযোগ্য ধারণাশুধু সহিহ হাদিসের সংকলন
উল্লেখযোগ্য কাজসহিহ বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ , তারিখ – আল কাবীর
মুসলিম নেতা
দেখানযার দ্বারা প্রভাবিত
দেখানযাদের প্রভাবিত করেন
জীবনী

ইমাম বুখারি (রহ.) ১৯৪ হিজরি সালের ১৩ শাওয়াল, শুক্রবার (৮১০ খ্রিস্টাব্দ) খোরাসানের বুখারা নগরীতে (বর্তমান উজবেকিস্তানের অংশ) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল ইসমাইল এবং দাদার নাম ইব্রাহিম। যদিও দাদা সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি, তবে তাঁর বাবা ইসমাইল ছিলেন তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব এবং একজন হাদিস বিশারদ। ইমাম বুখারীর পিতা ইসমাইল হাদিস শাস্ত্রবিদ আল্লামা হাম্মাদ ও ইমাম মালেকের শাগরিদ ছিলেন এবং বিখ্যাত মনীষী আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকের কাছেও শিক্ষালাভ করেছিলেন। এতে বোঝা যায়, ইমাম বুখারীর পরিবারের পক্ষে ধর্মীয় শিক্ষা ও হাদিসের জ্ঞানে যথেষ্ট সমৃদ্ধির প্রভাব ছিল।

শিক্ষা ও প্রাথমিক জীবন

ইমাম বুখারীর শিক্ষা ও জ্ঞানপ্রাপ্তির শেকড় শুধু পিতার দিক থেকেই নয়; বরং মাতার দিক থেকেও তিনি অনেক কিছু অর্জন করেন। তাঁর মা ছিলেন একজন বিদূষী ও ধর্মপ্রাণ মহিলা। একটি বিখ্যাত ঘটনা অনুসারে, ইমাম বুখারী ছোটবেলায় একটি কঠিন রোগে আক্রান্ত হন, যার ফলে তাঁর দুই চোখ প্রায় অন্ধ হয়ে যায়। মা তখন গভীরভাবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন। এক রাতে তিনি স্বপ্নে দেখতে পান যে, হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁর শিয়রে বসা এবং তাঁকে জানান যে আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেছেন। পরদিন সকালে তিনি লক্ষ্য করেন, ইমাম বুখারীর চোখের দৃষ্টি ফিরে এসেছে।

শিক্ষা ও জ্ঞানে অগ্রগতি

শৈশবেই তিনি তাঁর বাবাকে হারান এবং মায়ের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হন। ইমাম বুখারীর পিতা প্রচুর ধনসম্পদ রেখে গিয়েছিলেন, যা তাঁর শৈশব ও শিক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বাল্যকাল থেকেই ইমাম বুখারী শিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন। তিনি প্রথমে কোরআন শিক্ষা শুরু করেন এবং মাত্র ছয় বছর বয়সেই পুরো কোরআন মুখস্থ করেন। ১০ বছর বয়স থেকেই তিনি হাদিস মুখস্থ করতে শুরু করেন। কিশোর বয়সেই, মাত্র ১৬ বছর বয়সে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক ও ওয়াকীর পাণ্ডুলিপির সমস্ত হাদিস মুখস্থ করে ফেলেন।

ইমাম বুখারীর জীবন ও অবদান

পরবর্তী জীবনে ইমাম বুখারী অসংখ্য শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে বিশুদ্ধ হাদিস সংগ্রহ করেন। তাঁর বিখ্যাত সংকলন “সহিহ বুখারি” আজও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর কর্ম ও জ্ঞান, বিশেষত সহিহ বুখারি সংকলন, ইসলামি জ্ঞানের ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রাখে।

ইমাম বুখারী (রহ.)-এর শিক্ষাসফর ও স্মৃতিশক্তির প্রখরতা

শিক্ষাসফর

ইমাম বুখারী (রহ.) মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তাঁর মা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমন করেন। হজ সম্পন্ন করার পর তিনি মক্কাতেই থেকে যান এবং সেখানে হিজাযের বিখ্যাত হাদীসবিশারদদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করতে শুরু করেন। এ সময়ে তিনি “কাজায়াস সাহাবা ওয়াত তাবীয়ীন” নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এরপর ইমাম বুখারী হাদীসের বিশুদ্ধতা ও সঠিক তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ইরাক, সিরিয়া, মিশরসহ বহু স্থানে ভ্রমণ করেন। তিনি মুহাদ্দিসদের সান্নিধ্যে থেকে বিশুদ্ধ হাদীস সংকলনে মনোযোগী হন। ইমাম দাখেলির দরসে অংশগ্রহণ এবং ১৬ বছর পর নিজের জন্মভূমি বুখারায় প্রত্যাবর্তন তাঁর নিরলস অধ্যবসায়ের উদাহরণ।

স্মৃতিশক্তির প্রখরতা

১৮ বছর বয়সে ইমাম বুখারী দ্বিতীয়বার হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় যান। মক্কায় থেকে তিনি গভীর অধ্যবসায় ও পরিশ্রমে ইলমে হাদীস চর্চায় মনোযোগী হন এবং বিভিন্ন মুহাদ্দিসের কাছ থেকে এক হাজারেরও বেশি হাদীস সংগ্রহ করেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর, যা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছিল। কুস্তুলানীসহ বিশিষ্ট আলেমগণ উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ছয় লক্ষ হাদীসের হাফেয ছিলেন। তিনি যে কোনো কিতাব একবার পড়েই তা মুখস্থ করতে পারতেন।

একবার ইমাম দাখেলি একটি হাদীসের সনদে ‘জুবাইর’ এর স্থলে ‘আবু জুবাইর’ বলেন। ইমাম বুখারী নম্রভাবে তাকে সংশোধন করে বলেন, এখানে ‘আবু জুবাইর’ নয়, বরং ‘জুবাইর’ হবে। ইমাম দাখেলি পরে কিতাব দেখে নিশ্চিত হয়ে ভুল সংশোধন করেন এবং এরপর থেকে ইমাম বুখারীকে স্নেহ করতেন।

একবার ইমাম বুখারী তাঁর সহপাঠীদের অনুরোধে পনের হাজার (১৫,০০০) হাদীস ধারাবাহিকভাবে মুখস্থ শুনিয়ে তাঁদের মুগ্ধ করেন। ইমাম বুখারী নিজেই বলেছেন, “আমার অন্তরে এক লক্ষ সহিহ হাদীস ও দুই লক্ষ যঈফ হাদীস মুখস্থ রয়েছে।” মুহাদ্দিছ ইবনে খুযায়মা বলেন, “পৃথিবীতে ইমাম বুখারী অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞ এবং হাদিসের হাফেয আর কেউ জন্ম গ্রহণ করেননি।”

ইমাম বুখারী (রহ.)-এর এই জীবনীতে আমরা তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা, অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, এবং বিশুদ্ধ হাদীস সংকলনের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ও নিষ্ঠার পরিচয় পাই।

বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ

ইমাম বুখারীর
বুখারা, মক্কা, মদিনা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলিকে চিহ্নিত করে হাদিসের সন্ধানে ইমাম বুখারীর বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের চিত্রিত মানচিত্র এখানে রয়েছে।

মানচিত্রে হাদিস অন্বেষণে ইমাম বুখারীর সফর।
হাদিস সংগ্রহের জন্য ইমাম বুখারী “অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম কড়ে অনেক দেশ ভ্রমন করেছেন”।সে সময় যে সমস্ত দেশে বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ বসবাস করতেন তার প্রায় সবগুলোতেই তিনি ভ্রমণ করেছেন এবং তাদের নিকট থেকে হাদিস সংগ্রহ করেছেন। খোরাসানের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও তিনি যে সমস্ত দেশে ভ্রমণ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে মক্কা, মদীনা, ইরাক, হিজাজ, সিরিয়া, মিশর এবং আরও অনেক শহর।

বাগদাদে ইমাম বুখারীর স্মরণশক্তির পরীক্ষা

ইমাম বুখারীর স্মরণশক্তি ও হাদিস জ্ঞানের খ্যাতি তৎকালীন সমগ্র ইসলামী জগতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই খ্যাতির প্রমাণ নিতে এবং তাঁর জ্ঞানের গভীরতা যাচাই করতে বাগদাদের বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ তাঁকে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। একবার বাগদাদে আগমনের পরপরই, ৪০০ জন মুহাদ্দিস একত্রিত হয়ে ১০০টি সহীহ হাদিস নির্বাচন করেন এবং প্রতিটি হাদিসের সনদ ও মতন পাল্টিয়ে দেন। পরে এসব হাদিসকে ১০ ভাগে বিভক্ত করে, প্রত্যেক ভাগের ১০টি করে হাদিস এক একজন মুহাদ্দিসের কাছে সোপর্দ করা হয়।

ইমাম বুখারীর সম্মানে মজলিস স্থাপন করা হলো। সেখানে বসার পর এক একজন মুহাদ্দিস এসে প্রতিটি হাদিস তাঁর সামনে পাঠ করতে শুরু করেন। প্রথম মুহাদ্দিসের ১০টি হাদিস পাঠ শেষ হওয়ার পরপরই ইমাম বুখারী বলেন, “এ ধরনের কোনো হাদিস আমার জানা নেই।” একইভাবে পরবর্তী ৯ জন মুহাদ্দিসও তাঁর সামনে সনদ ও মতন পাল্টানো হাদিসগুলো পড়েন এবং প্রতিবারই তিনি জানান, “এ ধরনের কোনো হাদিস আমার জানা নেই।” এভাবে মোট ১০০টি পাল্টানো হাদিসের ক্ষেত্রে একই উত্তর দেন ইমাম বুখারী।

অবশেষে, ইমাম বুখারী সবাইকে একত্রে ডেকে নেন এবং প্রত্যেকটি হাদিসের সনদ ও মতনকে সঠিকভাবে সাজিয়ে দিয়ে মূল রূপে ফিরিয়ে দেন। তিনি একেকটি হাদিসকে তার আসল সনদ ও মতনে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে, কোনো রাবীর নাম বা মতন থেকে একটি শব্দও বাদ পড়েনি এবং কোনো ভুল-ত্রুটি ছিল না। এই চমৎকার স্মৃতিশক্তি এবং হাদিস জ্ঞানের গভীরতা দেখে মুহাদ্দিসগণ তাঁর সামনে শ্রদ্ধায় নত হন এবং তৎকালীন ইসলামী জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতি প্রদান করেন।

কথিত আছে, সমরকন্দেও তাঁকে একইভাবে পরীক্ষা করা হয়েছিল, এবং সেখানেও তিনি সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ইমাম বুখারীর এই অভূতপূর্ব স্মৃতিশক্তি ও হাদিস জ্ঞানের জন্য ইসলামের ইতিহাসে তিনি সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হিসেবে বিবেচিত হন।


ইমাম বুখারীর উস্তাদ ও ছাত্রগণ

ইমাম বুখারী থেকে অসংখ্য মুহাদ্দিস “সহীহ বুখারী” বর্ণনা করেছেন। খতীব বাগদাদী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে ফিরাবরির বরাতে উল্লেখ করেন যে, ইমাম বুখারীর থেকে সরাসরি সহীহ বুখারী পড়েছেন প্রায় সত্তর হাজার ব্যক্তি। এই বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ ইমাম বুখারীর জ্ঞান ও স্মরণশক্তির প্রশংসায় পরিপূর্ণ ছিলেন।

ইমাম বুখারীর উল্লেখযোগ্য ছাত্ররা:

১. ইমাম মুসলিম – “সহীহ মুসলিম” নামে একটি বিশুদ্ধ হাদিস সংকলনের রচয়িতা।
২. ইমাম তিরমিজি – “সুনান আত-তিরমিজি” হাদিস গ্রন্থের রচয়িতা।
৩. ইমাম নাসাঈ – “সুনান আন-নাসাঈ” গ্রন্থের লেখক।
৪. আবু হাতেম রাজি
৫. আবু যুররা
৬. ছালেহ বিন মুহাম্মদ
৭. ইমাম আবু বকর বিন খুয়ায়মা
৮. ইয়াহইয়া ইবনে মুহাম্মদ

ইমাম বুখারীর উস্তাদগণ:

ইমাম বুখারী হাদিসের জ্ঞান অর্জনের জন্য অনেক অঞ্চলে ভ্রমণ করেছেন এবং সে সময়ের বিখ্যাত মুহাদ্দিসদের কাছে হাদিস শিখেছেন। তাঁর উস্তাদগণের মধ্যে অন্যতম:

১. মক্কা – আবু ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল্লাহ ও ইসমাঈল বিন সালাম
২. বলখ – মক্কী ইবনে ইবরাহীম বলখী ও ইয়াহিয়া ইবনে শিবর
৩. হেরা – আহমদ ইবনে ওয়ালীদ
৪. নিশাপুর – ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ ও ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া
৫. রাই প্রদেশ – ইব্রাহীম মুসা
৬. বাগদাদ – মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ও মুহাম্মদ বিন সাবিত এবং আহমদ বিন হাম্বল
৭. বসরাহ – আবু আসেম ও সাফওয়ান বিন ঈসা
৮. জাজীরা – আহমদ বিন আব্দুল মালেক ও আহমদ বিন ইয়াজিদ

ইমাম বুখারীর অন্যতম উস্তাদ ছিলেন মক্কী বিন ইবরাহিম, যাঁর সনদে ইমাম বুখারী “সুলাসিয়াত” হাদিস বর্ণনা করেছেন। উল্লেখযোগ্য যে, মক্কী বিন ইবরাহিম ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর ছাত্র ছিলেন।


সহীহ বুখারী
মূল নিবন্ধ: সহীহ বুখারী
ইমাম বুখারি (রহ.)
সহিহ বুখারি শরিফের কভারের ক্যালিগ্রাফি

ইমাম বুখারীর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ হলো হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ সহিহ বুখারী সংকলন। তাঁর শিক্ষক ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ একটি এমন গ্রন্থের প্রেরণা দিয়েছিলেন, যেখানে কেবল সহিহ হাদিস সংকলিত থাকবে। ইমাম বুখারী এই গুরুদায়িত্বে এগিয়ে আসেন এবং ২১৭ হিজরিতে মাত্র ২৩ বছর বয়সে মক্কার হারাম শরীফে এই গ্রন্থ সংকলন শুরু করেন। দীর্ঘ ১৬ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর, ২৩৩ হিজরিতে এই কাজ সমাপ্ত হয়।

গ্রন্থ সংকলনকালে ইমাম বুখারী বিশেষভাবে পরিশুদ্ধতা বজায় রাখতেন; প্রতিটি হাদিস সংযোজনের পূর্বে গোসল করে দু’ রাকাত নফল নামাজ পড়তেন এবং হাদিসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য মনোযোগ দিয়ে ধ্যান করতেন। তিনি শুধুমাত্র তার নির্ধারিত শর্তে উত্তীর্ণ সহিহ হাদিসগুলোই এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেন। নিজেই তিনি বলেছিলেন, “আমি আমার গ্রন্থে কেবল সহিহ হাদিস রেখেছি, তবে বইয়ের কলেবর বড় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেক সহিহ হাদিস বাদ দিয়েছি।”

ইমাম বুখারীর সংকলনের পরিপূর্ণ নাম হলো আল-জামি আল-সাহীহ আল-মুসনাদ মিন উমুরি রাসূলিল্লাহ ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়ামিহি। তাঁর মতে, গ্রন্থটির সংকলন স্থান বিভিন্ন হতে পারে কারণ তিনি মক্কা, বসরা, ও বুখারা সহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেছিলেন। তবে, বসরায় পাঁচ বছর অবস্থানকালে তিনি গ্রন্থটির চূড়ান্ত সংকলন করেন।

এই বিখ্যাত গ্রন্থে মোট ৭১৭৫টি হাদিস আছে, তবে পুনরুক্ত বাদে সংখ্যা প্রায় ৪০০০।

সহীহ বুখারী সংকলনের কারণ

ইমাম বুখারীর সহীহ বুখারী সংকলনের অন্যতম কারণ ছিল শুধুমাত্র সহীহ হাদিসগুলোকে একত্রিত করে এমন একটি গ্রন্থ রচনা করা, যা আগে কেউ করেননি। তাঁর পূর্ববর্তী আলেমগণ সহীহ এবং যঈফ হাদিসগুলোকে একই সংকলনে সংরক্ষণ করতেন। তবে ইমাম বুখারী সিদ্ধান্ত নেন, শুধুমাত্র সহীহ হাদিসগুলোর একটি পৃথক সংকলন তৈরি করবেন।

এই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ও অনুপ্রেরণা তিনি তাঁর শিক্ষক ইসহাক ইবনে রাহওয়াই থেকে পান। ইমাম বুখারী বর্ণনা করেন, একদিন ইসহাক ইবনে রাহওয়াই তাঁর মজলিসে বলেছিলেন যে, “যদি কেউ হাদিসের একটি সংকলন রচনা করতো, যেখানে শুধুমাত্র সহীহ হাদিসগুলো স্থান পেতো, তাহলে তা কতই না ভালো হতো।” ইমাম বুখারী তাঁর শিক্ষকের কথায় গভীরভাবে প্রভাবিত হন এবং ঠিক করেন, এই মহান দায়িত্ব তিনি নিজেই পালন করবেন।

তাছাড়া, তিনি একটি স্বপ্ন দেখেন, যেখানে তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শরীর থেকে মাছি তাড়াচ্ছেন। আলেমগণ এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেন যে, রাসূলের হাদিসের সঙ্গে বানোয়াট ও জাল হাদিস মিশ্রিত হওয়ায় তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। এটি ইমাম বুখারীকে আরো অনুপ্রাণিত করে।

সহীহ বুখারী রচনায় বুখারীর সতর্কতা

ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ বুখারী রচনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন। এই গ্রন্থে শুধুমাত্র সহীহ হাদিস সংগ্রহ করার জন্য তিনি এমন কিছু কঠোর শর্ত আরোপ করেছিলেন, যা তাঁর সমসাময়িকদের চেয়ে আরও কঠোর ও নিখুঁত বলে বিবেচিত। যদিও তিনি সরাসরি তাঁর শর্তগুলো উল্লেখ করেননি, তবে আলেমগণ তাঁর রচনাকর্ম বিশ্লেষণ করে কয়েকটি মূল শর্ত নির্ধারণ করেছেন:

  1. রাবীদের সমসাময়িকতা ও সাক্ষাত: হাদিসের রাবী ও তার উপরের রাবীর সমসাময়িকতা প্রমাণিত হওয়া এবং উভয়ের মাঝে সাক্ষাতের ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। এটি অন্যান্য মুহাদ্দিসদের চেয়ে কঠোর শর্ত, যেখানে ইমাম মুসলিম শুধু সাক্ষাতের সম্ভাবনা মেনে নিয়েছিলেন।
  2. রাবীর নির্ভরযোগ্যতা: প্রতিটি রাবীকে ছিকাহ (নির্ভরযোগ্য) হতে হবে।
  3. ন্যায়পরায়ণতা ও সততা: রাবীকে ন্যায়পরায়ণ এবং কথাবার্তা ও লেনদেনে সৎ হতে হবে।
  4. মেমোরি বা স্মৃতি শক্তি: রাবীর স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর ও পূর্ণাঙ্গ হওয়া আবশ্যক।
  5. মুত্তাসিল সনদ: হাদিসের সনদ বা বর্ণনাকারীদের শৃঙ্খলায় কোনো রাবী বাদ পড়বে না।

প্রতিটি হাদিস সংকলনের আগে ইমাম বুখারী গোসল করে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতেন এবং ইস্তেখারা করতেন। হাদিসের শর্ত অনুযায়ী সহীহ প্রমাণিত হলেও, যদি তাঁর মনে সামান্য সন্দেহ জাগতো, তবে তিনি তা সহীহ বুখারী তে অন্তর্ভুক্ত করতেন না। এই কঠোর পরিশ্রমের ফলে তিনি মসজিদে নববীতে বসে টানা ১৬ বছর এই মহৎ কাজ সম্পন্ন করেন।

ইমাম বুখারী দ্রুত গ্রন্থটি প্রকাশ করেননি; বরং তিনবার পুরো সংকলনটি পুনর্বিবেচনা ও পরিমার্জন করেছেন। তাঁর বন্ধু ও শিক্ষাগণ, যেমন আহমাদ ইবনে হাম্বাল, আলী ইবনুল মাদীনী, ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন প্রমুখ, এই গ্রন্থের প্রশংসা করে একে সহীহ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এজন্য, সহীহ বুখারী মুসলিম বিশ্বের কাছে আল-কুরআনের পর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে সম্মানিত।

আলেমদের মূল্যায়নে সহীহ বুখারী

সহীহ বুখারী কিতাবটি তার সংক্ষিপ্ত নামেই অধিক প্রসিদ্ধ, তবে এর পূর্ণ নামটি হলো আল-জামেউস সহীহহুল মুসনাদু মিন উমুরি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়ামিহি। যদিও দীর্ঘ এই নামের শব্দ বিন্যাসে কিছু পার্থক্য আছে বলে অনেকে মনে করেন। ইমাম বুখারী এই কিতাবে প্রথমবারের মতো হাদিসসমূহকে আধুনিক পদ্ধতিতে শ্রেণিবদ্ধ করে একটি সুবিন্যস্ত গ্রন্থ রচনা করেন।

এই গ্রন্থ রচনার জন্য ইমাম বুখারী মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থান করেন এবং মসজিদে নববীতে বসে ১৬ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তাঁর একাগ্র সাধনা ও কঠোর পরিশ্রমের ফল হিসেবে সহীহ বুখারী এমন এক মহৎ গ্রন্থে পরিণত হয় যা সকল যুগের আলেমদের নিকট অত্যন্ত সম্মানিত। মুসলিম বিশ্বে এটি পবিত্র আল-কুরআনের পর সবচেয়ে পবিত্র ও বিশ্বাসযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে গণ্য হয়।

সহীহ বুখারী ব্যাখ্যার জন্য বিভিন্ন আলেম অসংখ্য ব্যাখ্যা গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানীর ফতহুল বারী সর্বোত্তম এবং সর্বাধিক সমাদৃত।


চরিত্রের দিকসমূহ

তার এবাদত-বন্দেগী ও পরহেজগারীতার কিছু বিবরণ

ইমাম বুখারী হাদিস চর্চায় সর্বদা মগ্ন থাকলেও এবাদত-বন্দেগী এবং আল্লাহভীতি থেকে তিনি কখনো পিছিয়ে ছিলেন না। জীবনীতে উল্লেখ আছে যে, প্রতি বছর রমযান মাসের দিনে তিনি একবার কুরআন খতম করতেন। আর তারাবীর নামায শেষে প্রতি তিন রাতে কুরআন খতম করতেন। মুহাম্মদ বিন আবু হাতিম আল-ওয়াররাক বলেন, ইমাম বুখারী প্রতি রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ অনুসরণ করে তের রাকআত তাহাজ্জুদ পড়তেন।

তার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তার কবর থেকে এক প্রকার সুগন্ধি বিচ্ছুরিত হতে শুরু করে, যা দেখে মানুষ তার কবর থেকে মাটি নিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে এটি বন্ধ করার জন্য কবরটি কাঁটা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। এরপর এক ওলী লোকদের আকিদা নষ্টের আশঙ্কায় দোয়া করলে আল্লাহর রহমতে সেই সুগন্ধি বন্ধ হয়ে যায়।

ইমাম বুখারীর দানশীলতা ও উদারতা

ইমাম বুখারী ছিলেন প্রচুর ধনসম্পদের মালিক এবং অত্যন্ত দানশীল ও উদার হৃদয়ের অধিকারী। মুহাম্মাদ বিন আবু হাতিম বর্ণনা করেন, ইমাম বুখারীর বেশ কিছু জমি ছিল, যা থেকে প্রতি বছর তিনি প্রায় সাত লক্ষ দিরহাম আয় করতেন। এই বিপুল অর্থ থেকে তিনি নিজের জন্য খুব সামান্যই খরচ করতেন। খাদ্যের ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সংযমী ছিলেন এবং অধিকাংশ সময় শসা, তরমুজ ও সবজি খেয়ে জীবনযাপন করতেন।

ইমাম বুখারী তার আয়ের প্রায় পুরো অংশই জ্ঞান অর্জনের পথ এবং অভাবী ও দরিদ্র মানুষের সেবায় ব্যয় করতেন। তিনি সর্বদা নিজের সঙ্গে দিনার ও দিরহামের থলে রাখতেন, যাতে যে কোনো মুহাদ্দিস বা দরিদ্র ব্যক্তি অভাবে পড়লে তাদের অবিলম্বে সহায়তা করতে পারেন।

জীবনীর স্মরণীয় ঘটনা

ইমাম বুখারীর জীবনে একটি অত্যন্ত স্মরণীয় ঘটনা উল্লেখ করা হয়। একবার তিনি একটি থলেতে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে হাদিস অন্বেষণের জন্য সফরে বের হন। এই সফরের মধ্যেই এক চোর সেই স্বর্ণমুদ্রাগুলো দেখে ফেলে এবং তা চুরি করার জন্য তার পিছু নেয়। পথিমধ্যে ইমাম বুখারী জাহাজে আরোহণ করলে সেই চোরও তার সাথে যাত্রা শুরু করে এবং সেখানে চুরি করার কৌশল অবলম্বন করে। চোর চিৎকার করে দাবি করতে থাকে যে, তার এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা চুরি হয়েছে, এবং থলেটির ধরনও বর্ণনা করে। এতে জাহাজের মাঝি-মাল্লারা সকল যাত্রীকে তল্লাশি করতে শুরু করে।

এই পরিস্থিতিতে ইমাম বুখারী চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং ভাবেন, যদি মুদ্রাগুলো তার কাছ থেকে পাওয়া যায় তবে তাকে চোর সাব্যস্ত করা হবে। এমন কলঙ্ক ইলমে হাদিসের সম্মানে আঘাত আনতে পারে। তাই ইমাম বুখারী রাসূলের হাদিসের মর্যাদা রক্ষা করতে এবং নিজের সারা জীবনের সাধনা ও সততার সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে স্বর্ণমুদ্রার থলেটি পানিতে ফেলে দেন।

পরবর্তীতে তল্লাশির পরেও জাহাজের কারো কাছে স্বর্ণমুদ্রা না পাওয়ায়, চোর মিথ্যাবাদী হিসেবে ধরা পড়ে। চোর পরে ইমামের কাছে এসে জানতে চায় যে, মুদ্রাগুলো কোথায় রেখেছেন। ইমাম বুখারী উত্তরে জানান, চোরের চক্রান্ত বুঝতে পেরে তিনি তা পানিতে ফেলে দিয়েছেন।


ইমাম বুখারী সম্পর্কে আলেমদের কিছু অভিমত:

ইমাম বুখারীর সম্পর্কে বিভিন্ন আলেমগণ অত্যন্ত প্রশংসামূলক মন্তব্য করেছেন, যা তার জ্ঞানের গভীরতা, হাদিসের ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষজ্ঞতার স্বীকৃতি ও মর্যাদাকে আরও উচ্চতর করে তুলেছে।

১) ইমাম ফাল্লাস বলেন, “যে হাদীস সম্পর্কে ইমাম বুখারী জানেন না, সেটি আদৌ হাদীস নয়।” তার এ মন্তব্য ইমাম বুখারীর অসাধারণ হাদিস জ্ঞানের প্রতি ইঙ্গিত করে।

২) ইমাম আবু নুআইম আহমাদ বিন হাম্মাদইয়াকুব বিন ইবরাহীম বলেন, “ইমাম বুখারী এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ ফকীহ।” এর মাধ্যমে তারা বুখারীর গভীর বিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।

৩) আলী বিন হাজার বলেন,. “তার মত আর কেউ আছে বলে আমার জানা নেই.।” এ মন্তব্য ইমাম বুখারীর অদ্বিতীয় জ্ঞান ও গুণাবলির প্রতি বিশেষভাবে ইঙ্গিত করে।

৪) কুতাইবা বলেন,. “পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম হতে আমার নিকট অনেক লোক এসেছে,. কিন্তু মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল বুখারী যতবার এসেছে, আর কেউ এতবার আসেনি।”

৫) ইমাম আবু হাতিম রাযী বলেন., “যে সমস্ত মুহাদ্দিছ বাগদাদে এসেছেন,. তাদের মধ্যে সবচেয়ে অধিক জ্ঞানী হলেন ইমাম বুখারী.।”

৬) ইমাম তিরমিজী বলেন,. “হাদীছের ইল্লত, ইতিহাস এবং সনদ সম্পর্কে বুখারীর চেয়ে অধিক জ্ঞানী ইরাক এবং খোরাসানের যমীনে আর কাউকে দেখিনি.।”

৭) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল বলেন,. “খোরাসানের যমীনে ইমাম বুখারীর অনুরূপ আর কেউ জন্ম গ্রহণ করেনি.।”

৮) ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী বলেন, “ইমাম বুখারীর সমকক্ষ আর কেউ ছিল না।”

এই মন্তব্যগুলো তার যুগের আলেমদের কাছে ইমাম বুখারীর জ্ঞানের বিস্তার এবং হাদিসের প্রতি তার অবদানের বিশালতা প্রতিফলিত করে।


রচনাবলী

ইমাম বুখারী (রহ.) রচিত গ্রন্থসমূহ তার অসাধারণ জ্ঞান ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করে। তিনি প্রায় ২০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন, যদিও তাদের কিছু বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং কিছু পান্ডুলিপি আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ও সমাদৃত হলো সহীহ আল-বুখারী

তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলী হলো:

  1. কাজায়া আস-সাহাবা ওয়া আত-তাবিয়ীন (قضايا الصحبة و التابعين)
  2. আত-তারীখ আস-সগীর (التاريخ الصغير)
  3. আল-আদাব আল-মুফরাদ (الأدب المفرد)
  4. কিতাব আল-জুআফা আস-সগীর (كتاب الضعفاء الصغير)
  5. কিতাব আল-কুনা (كتاب الكُنى)
  6. কিতাবু খালকি আফআলিল ইবাদ (كتاب خلق أفعال العباد)
  7. সহীহ আল-বুখারী (صحيح البخاري)
  8. রাফওল ইয়াদাইন ফিস সালাত
  9. কিরাআত খলফিল ইমাম
  10. আত-তারিখুল কবির
  11. আত-তারিখুল ওয়াসাত
  12. খালকু আফয়ালিল ইবাদ
  13. আল জামেউল কবির
  14. আল মুসনাদুল কবির
  15. কিতাবুল আশরিয়া
  16. ওসামাস সাহাবা
  17. কিতাবুল মারসুত
  18. কিতাবুল বিজদান

ইমাম বুখারীর এই গ্রন্থাবলীতে হাদিসের সঠিক সংরক্ষণ, সাহাবা ও তাবিয়ীনদের ঘটনা, ইসলামী আচার-আচরণ, ন্যায়বিচার, ইবাদতের গুরুত্বসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য অমূল্য সম্পদ হিসেবে রয়ে গেছে।


ইমাম বুখারীর শেষ জীবন ও কঠিন পরীক্ষা

ইমাম বুখারীর জীবন অত্যন্ত কঠিন ও প্রতিকূলতার মধ্যে অতিবাহিত হয়েছিল। যখন তিনি ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হিসেবে পরিচিতি পান, তখন বুখারার আমীর তার সন্তানদের জন্য বুখারী পড়ানোর প্রস্তাব দেন। ইমাম বুখারী এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তিনি মনে করেন যে এটি হাদীসের বিজ্ঞানের প্রতি অবমাননা। তিনি আমীরকে বলেন যে, তার সন্তানদেরকে মসজিদে পাঠানো উচিত, যেখানে তিনি সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেন।

এতে আমীর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং ইমাম বুখারীকে দেশত্যাগে বাধ্য করেন। তিনি ইমামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করার জন্য কিছু আলেম নিয়োগ করেন। এই ঘটনাগুলো ইমাম বুখারীকে জন্মভূমি বুখারা ছেড়ে নিশাপুরে নিয়ে যায়, কিন্তু সেখানে একই ধরনের প্রতিকূলতা তাকে আবার বাধ্য করে সমরকন্দের খরতঙ্গ নামক স্থানে চলে যেতে।

যখন ইমাম বুখারী বুখারা ত্যাগ করেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন যে, আমীর যেন তার অপমানের জন্য শাস্তি পায়। কিছুদিন পর, খুরাসানের আমীর খালেদ বিন আহমাদ জনগণের বিদ্রোহের শিকার হন এবং ক্ষমতাচ্যুত হন। পরবর্তীতে তিনি বাগদাদের জেলে মৃত্যুবরণ করেন।

এভাবে, ইমাম বুখারীর জীবন তাঁর নৈতিকতা ও ঈমানের জন্য অসংখ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে চলে যায়, যা ইতিহাসে তাঁর অবদানের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

মৃত্যু

ইমাম বুখারীর কবর, সমরকন্দ
ইমাম বুখারীর কবর, সমরকন্দ

ইমাম বুখারীর জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন, যখন বুখারার শাসক খালিদ বিন আহমাদ যুহলী তাঁর প্রতিভা ও পাণ্ডিত্য দেখে তাকে রাজ দরবারে এসে শাসককের সন্তানদেরকে হাদীস শেখানোর জন্য অনুরোধ করেন। ইমাম বুখারী এই প্রস্তাবকে হাদীসের প্রতি অবমাননা হিসেবে মনে করেন এবং এতে উভয়ের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়।

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে, ইমাম বুখারী মাতৃভূমি বুখারা ত্যাগ করে সমরকন্দের খরতঙ্গ নামক স্থানে চলে যান। সেখানেই তিনি জীবনযাপন করতে থাকেন এবং পরবর্তীতে ২৫৬ হিজরীর ১লা শাওয়াল, মোতাবেক ৩১শে আগস্ট ৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের শুক্রবার দিবাগত রাতে মৃত্যুবরণ করেন।

ইমাম বুখারীর মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও, তাঁর শিক্ষা ও গবেষণা তাঁর মৃত্যুর পরও অনন্য মর্যাদা লাভ করে। পরদিন শনিবার যোহরের নামাজের পর তাঁকে খরতঙ্গেই সমাহিত করা হয়। তাঁর জীবনের শেষ সময়ের এই ঘটনাবলী এবং তাঁর হাদীসের প্রতি নিবেদন ইসলামের ইতিহাসে তাঁর অবদানের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে।


তথ্যসূত্র

এই উত্সগুলি থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয় এবং সেগুলো ইমাম বুখারীর জীবনের বিভিন্ন দিক এবং তাঁর অবদানকে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে।

১. S. ‘Abdul-Maujood, “The Biography of Imam Bukharee” – এই বইটি ইমাম বুখারীর জীবনের একটি বিস্তারিত জীবনী উপস্থাপন করে, যা তাঁর ব্যক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক অর্জন তুলে ধরে।

২. ইসলামী বিশ্বকোষ – বাংলাদেশে প্রকাশিত এই বিশ্বকোষটি ইসলামের বিভিন্ন দিক ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে এবং এখানে ইমাম বুখারীর অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

৩. Ibn Rāhwayh, Isḥāq (১৯৯০) – এটি হাদীসের জগতে ইমাম বুখারীর অবদানের পাশাপাশি অন্যান্য মুহাদ্দিসদের কাজের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে।

৪. দুহাল ইসলাম (ইসলামের দ্বিপ্রহর) – ডা. আহমাদ আমীন রচিত এই বইয়ে ইসলামের ইতিহাস ও বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের অবদানের আলোচনা রয়েছে, যেখানে ইমাম বুখারীও উল্লেখিত।

৫. মুহাম্মাদ তাকী উসমানী – এই লেখায় ইমাম বুখারীর দেশের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে, যা তাঁর জীবনের প্রেক্ষাপট এবং প্রভাবকে বিশ্লেষণ করে।

এই ধরনের গবেষণা এবং সাহিত্য ইমাম বুখারীর জীবন, কর্ম এবং ইসলামের ইতিহাসে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানকে স্পষ্ট করে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *