ইরানের ইতিহাস প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে চলমান একটি ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতা,

ইরানের ইতিহাস প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে চলমান একটি ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতা, যা পারস্য সাম্রাজ্যের উত্থান, ইসলামিক বিপ্লব, এবং আধুনিক ইরানের মাধ্যমে অতিক্রান্ত হয়েছে। এই ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালে সাম্রাজ্যবাদের উত্থান-পতন, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে ইরানের সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ধারা গঠিত হয়েছে। এখানে ইরানের ইতিহাসের প্রধান পর্বগুলো ২০০০ শব্দের মধ্যে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো:

প্রাচীন পারস্য: আখেমেনীয় সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ – ৩৩০)

ইরানের ইতিহাসের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পর্বটি শুরু হয় আখেমেনীয় সাম্রাজ্যের মাধ্যমে, যা খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালে সাইরাস দ্য গ্রেট প্রতিষ্ঠা করেন। সাইরাস পারস্যের প্রথম মহাসাম্রাজ্য গড়ে তোলেন, যা সেই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। তার শাসনামলে পারস্য সাম্রাজ্য ইরান থেকে শুরু করে লিডিয়া (আধুনিক তুরস্ক) এবং ব্যাবিলন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। সাইরাসকে তার মানবিক শাসনের জন্য বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়, এবং তার শাসনকালে “সাইরাস সিলিন্ডার” নামে পরিচিত একটি মানবাধিকারের প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়, যা শাসনকালের বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে।

দারিউস দ্য গ্রেট (খ্রিস্টপূর্ব ৫২২-৪৮৬) এবং জার্কসিস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬-৪৬৫) সাম্রাজ্যকে আরও প্রসারিত করেন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। দারিউস ইম্পেরিয়াল রাজধানী হিসেবে পার্সেপোলিস প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সুসংগঠিত করেন। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের হাতে আখেমেনীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

হেলেনিস্টিক যুগ এবং পার্থিয়ান সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ – ২২৪)

আলেকজান্ডারের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তার সেনাপতি সেলিউকাস পারস্যে সেলিউসিড সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়ে ইরানে গ্রিক সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক পদ্ধতির প্রভাব বৃদ্ধি পায়। তবে পার্থিয়ানরা, যাদের উৎপত্তি ইরানের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে, খ্রিস্টপূর্ব ২৪৭ সালে সেলিউসিডদের পরাজিত করে নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। পার্থিয়ান সাম্রাজ্য দীর্ঘদিন রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে, বিশেষ করে রাস্তা এবং বাণিজ্যিক পথগুলির নিয়ন্ত্রণের জন্য।

ইরানের ইতিহাস প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে চলমান একটি ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতা,
শাহ মসজিদ (ফার্সি: مسجد شاه ইরানের ইসফাহানে অবস্থিত একটি মসজিদ। এটি নাগশ-ই জাহান স্কোয়ারের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। এটি সাফাভিদ সাম্রাজ্যের সময় মহান আব্বাসের আদেশে নির্মিত হয়েছিল।

সাসানীয় সাম্রাজ্য (২২৪ – ৬৫১)

সাসানীয় সাম্রাজ্য পারস্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য। আরদাশির প্রথম সাসানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন ২২৪ সালে। সাসানীয়রা আখেমেনীয়দের উত্তরসূরী হিসেবে নিজেদের দেখতো এবং পারস্যের গৌরব পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল। সাম্রাজ্যটি ইরান, ইরাক, সিরিয়া এবং মিশরসহ বিস্তৃত ছিল। শাপুর প্রথম এবং খসরু আনোশিরওয়ানের শাসনামলে সাম্রাজ্য সাংস্কৃতিক ও সামরিক শিখরে পৌঁছায়। সাসানীয় আমলে পার্সি ধর্ম (জরথুষ্ট্রবাদ) রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

তবে, ৬৫১ সালে আরব মুসলিমদের আক্রমণে সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। আরবরা সাসানীয়দের শেষ রাজা ইয়াজদেগার্দ তৃতীয়কে পরাজিত করে পারস্যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে।

ইসলামী যুগ (৬৫১ – ১২৫৮)

আরব বিজয়ের পর ইরানে ইসলামের বিস্তার ঘটে এবং শিয়া ইসলামের অগ্রগতি শুরু হয়। প্রথমদিকে ইরান উমাইয়া ও পরে আব্বাসীয় খিলাফতের অধীনে ছিল। তবে এই সময়ে ইরানিরা আরব শাসনের বিরোধিতা করেছিল এবং নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেছে। আব্বাসীয় শাসনামলে ইরানি বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও কবিরা ইসলামী সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠেন। আল-রাজি, ইবনে সিনা (আভিসেনা) এবং আল-বিরুনির মতো বিজ্ঞানীরা ইরানি বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

সাফাভিদ সাম্রাজ্য (১৫০১ – ১৭৩৬)

সাফাভিদ সাম্রাজ্য ইরানের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। ইসমাইল প্রথম ১৫০১ সালে সাফাভিদ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিয়া ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। সাফাভিদরা ইরানের রাজনৈতিক একীকরণ এবং শিয়া ইসলামের বিস্তার ঘটায়। এই সাম্রাজ্য শিয়া মতবাদের প্রচলনের মাধ্যমে ইরানের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে দৃঢ় করে।

শাহ আব্বাস প্রথমের শাসনামলে (১৫৮৮-১৬২৯) সাফাভিদ সাম্রাজ্য তার শিখরে পৌঁছে। তিনি নতুন রাজধানী ইস্পাহান প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাণিজ্য ও শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটান। তবে সাফাভিদদের সামরিক দুর্বলতার কারণে তারা আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং আফগান আক্রমণে পতিত হয়।

আফশার এবং কাজার রাজবংশ (১৭৩৬ – ১৯২৫)

সাফাভিদদের পতনের পর ইরানে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। নাদির শাহ আফশার ১৭৩৬ সালে আফশার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। নাদির শাহ সামরিক দক্ষতার জন্য পরিচিত ছিলেন এবং তার শাসনামলে ইরান পুনরায় সামরিক শক্তি অর্জন করে। তবে তার মৃত্যুর পর ইরান আবারো দুর্বল হয়ে পড়ে।

১৭৭৯ সালে কাজার রাজবংশ ক্ষমতায় আসে এবং ১৯২৫ সাল পর্যন্ত ইরান শাসন করে। কাজারদের শাসনামলে ইরান বিদেশী শক্তির প্রভাবের মধ্যে পড়ে। ব্রিটেন ও রাশিয়া ইরানের অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে ব্যাপক হস্তক্ষেপ করে। ১৯০৬ সালে প্রথমবারের মতো ইরানে সাংবিধানিক বিপ্লব ঘটে এবং একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে কাজাররা ইরানের আধুনিকায়নে ব্যর্থ হয় এবং তাদের শাসনামলে ইরান দুর্বল হয়ে পড়ে।

পাহলভি রাজবংশ (১৯২৫ – ১৯৭৯)

১৯২৫ সালে রেজা শাহ পাহলভি কাজারদের পরাজিত করে পাহলভি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। রেজা শাহ ইরানের ব্যাপক আধুনিকায়ন এবং পশ্চিমাকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেন। তিনি সামরিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন রেজা শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং তার ছেলে মোহাম্মদ রেজা শাহকে ক্ষমতায় বসায়।

মোহাম্মদ রেজা শাহের শাসনামলে ইরানে “সাদা বিপ্লব” নামে একটি সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা ভূমি সংস্কার, নারীদের অধিকার এবং শিল্পায়নের দিকে মনোনিবেশ করে। তবে তার স্বৈরাচারী শাসন এবং পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ইরানের জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। এর ফলে ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে একটি ইসলামী বিপ্লব ঘটে, যা রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায় এবং ইরানকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত করে।

অবস্থান মাশহাদ, ইরান, হারাম কমপ্লেক্স এবং ইমাম রেজা মাজার, ইরানের পবিত্রতম শহর - মাশহাদ-এর মাত্রা অনুসারে বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদ।
অবস্থান মাশহাদ, ইরান, হারাম কমপ্লেক্স এবং ইমাম রেজা মাজার, ইরানের পবিত্রতম শহর – মাশহাদ-এর মাত্রা অনুসারে বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদ।

ইসলামী বিপ্লব ও আধুনিক ইরান (১৯৭৯ – বর্তমান)

১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব ঘটে এবং ইরান একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। ইরানে একটি ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বাধীন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে শিয়া মতবাদকে ভিত্তি করে আইন ও শাসন পরিচালিত হয়। ১৯৮০ সালে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইরানে আক্রমণ করেন, যার ফলে ইরান-ইরাক যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং উভয় দেশই ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

ইরানের আধুনিক ইতিহাসে পারমাণবিক কর্মসূচি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ২০০০-এর

রেফারেন্স:

  1. Frye, R. N. The History of Ancient Iran. München: C.H. Beck, 1984.
  2. Amanat, Abbas. Iran: A Modern History. Yale University Press, 2017.
  3. Axworthy, Michael. Empire of the Mind: A History of Iran. Penguin Books, 2007.
  4. Curtis, Vesta Sarkhosh, and Sarah Stewart, eds. The Rise of Islam. I.B. Tauris, 2012.

এগুলো ইরানের ইতিহাসকে সংক্ষেপে তুলে ধরার জন্য প্রধান উৎস। ইরানের সমগ্র ইতিহাস আরও বিস্তারিতভাবে জানার জন্য উপরে উল্লেখিত বইগুলি পড়তে পারেন।

উপসংহার:

ইরানের ইতিহাস বহু প্রাচীন ও বহুমুখী। প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে আধুনিক ইসলামী প্রজাতন্ত্র পর্যন্ত, ইরানের ইতিহাসে ধর্ম, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির বিশাল পরিবর্তন হয়েছে। ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান একটি বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে উদ্ভাসিত হয়েছে এবং আজও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *