ফিলিস্তিনি ইতিহাস, ৩০০ শতাব্দী থেকে

ফিলিস্তিনি ইতিহাস, ৩০০ শতাব্দী থেকে >ফিলিস্তিনি ইতিহাসকে যদি ৩০০ শতাব্দী থেকে বিশ্লেষণ করা হয়, তবে এটি মূলত সেই অঞ্চলের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে আবর্তিত। এই সময়টি মূলত বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য থেকে শুরু হয়ে ইসলামী খিলাফতের উত্থান এবং ক্রুসেডারদের আক্রমণের মাধ্যমে চলমান সংঘাত এবং আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে বিস্তৃত হয়েছে। নিচে ৩০০ শতাব্দী থেকে শুরু করে ফিলিস্তিনের ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।

বাইজান্টাইন শাসন (৩০০-৬৩৮)

ফিলিস্তিন অঞ্চলে ৩০০ শতাব্দীর শুরুতে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের শাসন ছিল, যা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের একটি অংশ। এই সময়ে ফিলিস্তিন মূলত খ্রিস্টধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ৪র্থ শতাব্দীতে রোমান সম্রাট কনস্ট্যানটাইন খ্রিস্টধর্মকে রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই সময়ে ফিলিস্তিনের বেশ কয়েকটি স্থান খ্রিস্টধর্মের ধর্মীয় তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। জেরুজালেমে “চার্চ অফ দ্য হলি সেপালকার” নির্মিত হয়েছিল, যেখানে খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যে যীশু কবর দেওয়া হয়েছিল।

ফিলিস্তিনি ইতিহাস
আল-আকসা মসজিদ ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান হিসেবে বিবেচিত, এবং এটি ফিলিস্তিনের জেরুজালেম শহরের পুরনো শহর এলাকায় অবস্থিত। মুসলমানদের জন্য এটি এক ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
আল-আকসা মসজিদের ইতিহাস

ইসলামিক উত্থান এবং প্রথম মুসলিম শাসন (৬৩৮-১০৯৯)

৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলামী খিলাফত ফিলিস্তিন দখল করে। দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে খাত্তাবের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী বাইজান্টাইনদের পরাজিত করে এবং জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এই সময়ে, ফিলিস্তিন মুসলিম বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে, বিশেষ করে জেরুজালেম। এই শহরটি ইসলামের তৃতীয় পবিত্র শহর হিসেবে পরিচিত হয়, যেখানে “আল-আকসা মসজিদ” এবং “ডোম অফ দ্য রক” নির্মিত হয়েছিল।

উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফত

উমাইয়া খিলাফত (৬৬১-৭৫০) এবং পরবর্তী আব্বাসীয় খিলাফতের (৭৫০-১২৫৮) শাসনামলে ফিলিস্তিন একটি অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই সময়ে, মুসলিম স্থাপত্য, বাণিজ্য এবং ধর্মীয় তীর্থযাত্রা ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। জেরুজালেমের ধর্মীয় গুরুত্ব বাড়তে থাকে এবং এটি মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদি তীর্থযাত্রীদের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে।

ক্রুসেডার শাসন (১০৯৯-১১৮৭)

১০৯৯ সালে প্রথম ক্রুসেড শুরু হয়, যেখানে ইউরোপের খ্রিস্টান রাজারা ফিলিস্তিনে আগমন করে এবং জেরুজালেম দখল করে। ক্রুসেডাররা জেরুজালেমে একটি খ্রিস্টান শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং মুসলিম ও ইহুদি জনগণের ওপর অত্যাচার চালায়। এই সময়ে ফিলিস্তিন ক্রুসেডার শাসনের অধীনে ছিল এবং খ্রিস্টান রাজ্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

সালাহউদ্দিন ও আইউবী শাসন (১১৮৭-১২৫০)

সালাহউদ্দিন (সালাদিন) ১১৮৭ সালে ক্রুসেডারদের পরাজিত করে এবং জেরুজালেম পুনরায় দখল করেন। তিনি আইউবী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং মুসলিম শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনামলে ফিলিস্তিন আবারো মুসলিম শাসনের অধীনে আসে এবং বিভিন্ন ধর্মের মানুষ সহাবস্থানে থাকে। ক্রুসেডারদের সাথে বহুবার যুদ্ধ হলেও সালাহউদ্দিনের কৌশল ও নেতৃত্বের কারণে মুসলিম শাসন অব্যাহত থাকে।

মামলুক ও অটোমান শাসন (১২৫০-১৯১৭)

১২৫০ সালে মামলুকরা আইউবী শাসনকে উৎখাত করে ফিলিস্তিন দখল করে এবং প্রায় ২৬৭ বছর ফিলিস্তিনে শাসন করে। মামলুকরা ফিলিস্তিনের বিভিন্ন শহরের উন্নয়ন সাধন করে এবং ধর্মীয় স্থাপনাগুলো পুনঃনির্মাণ করে। ১৫১৭ সালে অটোমান সাম্রাজ্য ফিলিস্তিন দখল করে, এবং প্রায় ৪০০ বছর ফিলিস্তিন অটোমান শাসনের অধীনে ছিল। অটোমান শাসনামলে ফিলিস্তিন একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চল ছিল, যেখানে মুসলিম, খ্রিস্টান, এবং ইহুদি সম্প্রদায় একত্রে বসবাস করত।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেট (১৯১৭-১৯৪৮)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী অটোমান সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে এবং ফিলিস্তিন দখল করে। ১৯২০ সালে লীগ অফ নেশনসের অধীনে ফিলিস্তিনকে একটি ম্যান্ডেট হিসেবে ব্রিটেনের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সময় ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তীব্রভাবে জটিল হয়ে ওঠে। ১৯১৭ সালে জারি করা বালফোর ঘোষণা ইহুদি জনগণের জন্য একটি জাতীয় বাড়ির প্রতিশ্রুতি দেয়, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য ভিন্নমত ও রাজনৈতিক অসন্তোষ সৃষ্টি করে।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং ১৯৪৮ সালের যুদ্ধ

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি ভাগে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেয়—একটি ইহুদি রাষ্ট্র এবং একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে আরব রাষ্ট্রগুলো এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, এবং আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে ইসরায়েল বিজয়ী হয় এবং প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়ে আরব দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধ ফিলিস্তিনি ইতিহাসে “আল-নাকবা” (বিপর্যয়) নামে পরিচিত, যা ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য একটি গভীর মানসিক ও রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি হয়ে ওঠে।

ফিলিস্তিনি ইতিহাস
আল-আকসা মসজিদ ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান হিসেবে বিবেচিত, এবং এটি ফিলিস্তিনের জেরুজালেম শহরের পুরনো শহর এলাকায় অবস্থিত। মুসলমানদের জন্য এটি এক ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান।

ছয় দিনের যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ

১৯৬৭ সালে ইসরায়েল এবং আরব দেশগুলোর মধ্যে সংঘটিত ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। এই সময় থেকে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন এবং প্রতিরোধ সংঘাত তীব্রতর হয়। ফিলিস্তিনি লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করে এবং এটি ফিলিস্তিনি রাজনীতির কেন্দ্রীয় সংগঠন হয়ে ওঠে।

অসলো চুক্তি এবং সমকালীন ফিলিস্তিন

১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের মধ্যে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ শান্তিচুক্তি ছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে এই চুক্তি কার্যকরভাবে সফল হয়নি এবং ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি সংঘাত আজও চলমান।

বর্তমানে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দুটি প্রধান অংশে বিভক্ত: পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা। গাজা উপত্যকা হামাসের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যেখানে পশ্চিম তীর প্যালেস্টাইন অথরিটির অধীনে রয়েছে। ইসরায়েলি অবরোধ, বসতি স্থাপন, এবং সামরিক অভিযান ফিলিস্তিনিদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনি সংকটের সমাধানের চেষ্টা করলেও তা এখনও কার্যকর হয়নি।

উপসংহার

ফিলিস্তিনের ইতিহাস অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং জটিল। ৩০০ শতাব্দী থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত, এই অঞ্চলে শাসকদের পরিবর্তন ঘটেছে, ধর্মীয় সংঘাত বেড়েছে, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা লেগেই রয়েছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তবে এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং কঠিন প্রক্রিয়া। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনি জনগণের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এখনও একটি অমীমাংসিত বিষয়।

রেফারেন্স:

  1. Hourani, Albert. A History of the Arab Peoples. Faber & Faber, 1991.
  2. Khalidi, Rashid. Palestinian Identity: The Construction of Modern National Consciousness. Columbia University Press, 1997.
  3. Pappe, Ilan. The Ethnic Cleansing of Palestine. Oneworld Publications, 2006.
  4. Smith, Charles D. *Palestine and the Arab
আল-আকসা মসজিদের ইতিহাস
ফিলিস্তিনি ইতিহাস, ৩০০ শতাব্দী থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *