খায়বারের যুদ্ধ

খায়বারের এই যুদ্ধে আল্লাহর সাহায্যে মুসলিমরা বিজয় লাভ করেন

খায়বারের যুদ্ধ (আরবি: غزوة خيبر) ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত হয়। এটি মদিনা থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত খায়বার অঞ্চলের ইহুদি গোত্রের সাথে মুসলিমদের একটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ। খায়বার ছিল ইহুদিদের দুর্গনগরী, যেখানে তারা অবস্থান নিয়েছিল। মুসলিম বাহিনী তাদের উপর আক্রমণ চালায় এবং শেষ পর্যন্ত মুসলিমদের বিজয় হয়। এই যুদ্ধে আল্লাহর সাহায্যে মুসলিমরা বিজয় লাভ করেন এবং খায়বারের বিভিন্ন দুর্গ তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।

খায়বারের যুদ্ধ
মূল যুদ্ধ: মুহাম্মাদ সা. এর সামরিক অভিযানসমূহ
তারিখমে/জুন ৬২৮অবস্থানখায়বারফলাফলমুসলিমদের বিজয়
বিবাদমান পক্ষ
মুসলিম সেনাবাহিনীখায়বার মরুভূমির ইহুদিগণ
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
মুহাম্মাদ
আলী ইবনে আবি তালিব
আল-হারিস ইবনে আবু জয়নব
মারহাব ইবনে আবু জয়নব
শক্তি
১,৬০০খায়বার ১০,০০০বনু গাফতান৪,০০০
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
২০ জনের কম নিহত হন
৫০ আহত
৯৩ জন নিহত

খায়বারের যুদ্ধ সপ্তম হিজরিতে (৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে) সংঘটিত হয়, যার মূল কারণ ছিল খায়বারের ইহুদিদের মদিনা আক্রমণের পরিকল্পনা এবং নবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র। খায়বার ছিল ইহুদিদের একটি বড় উপনিবেশ, যেখানে তাদের অনেক দুর্গ ও খামার ছিল। তারা বনু কোরাইজা গোত্রকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত করেছিল এবং গাতাফান ও বেদুঈন গোত্রের সাথে মিলে মুসলমানদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিল।

যুদ্ধে পরাজিত ইহুদিদের নির্বাসনে না পাঠিয়ে নবী মুহাম্মাদ (সা.) চুক্তি করেন, যাতে ইহুদিরা প্রতি বছর তাদের উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক মুসলমানদের দিতে সম্মত হয়। যুদ্ধের পর, এক ইহুদি মহিলা নবী (সা.)-কে বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে হত্যার চেষ্টা করলেও, নবী (সা.) তাকে ও অন্য ইহুদিদের ক্ষমা করে দেন।

ইতিহাসবিদ উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াট ও লরা ভেক্সিয়া ভ্যাগ্লিয়েরি এই যুদ্ধে ইহুদিদের বিরোধী কর্মকাণ্ড এবং মুসলিম সাহাবাদের মধ্যকার প্রতিক্রিয়া, যুদ্ধলব্ধ সম্পদের উপযোগিতা ইত্যাদি কারণকে গুরুত্ব দেন।

খায়বারের যুদ্ধের পর ইহুদিদের অবরুদ্ধ করে তাদের সাথে একটি চুক্তি করা হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, খায়বারের ইহুদিরা প্রতি বছর তাদের উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক মুসলিমদের প্রদান করবে এবং তাদেরকে খায়বারে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়। খলিফা ওমরের শাসনামলে তাদেরকে খায়বার থেকে বহিষ্কৃত করার আগ পর্যন্ত এই শর্তে তাদের বসবাস অব্যাহত ছিল।

যুদ্ধের বিজয়ের পর, ইসলামী বিধান অনুযায়ী খায়বারের ইহুদিদের উপর জিজিয়া কর আরোপ করা হয়। এর মাধ্যমে তাদের অধিভুক্ত জমি মুসলিম প্রশাসনের অধীনে আসে। বিনিময়ে, ইহুদিরা ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্প্রদায়ের স্বায়ত্তশাসন, বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি এবং সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ ও যাকাত প্রদান থেকে অব্যাহতি পায়, যা মুসলিম নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল।

প্রেক্ষাপট

৭ম শতকের খায়বার

মূল নিবন্ধ: খাইবারের ইহুদি সম্প্রদায়

সমগ্র খায়বার মরুভূমি তখন তিনটি এলাকায় বিভক্ত ছিল: আল-নাতাত, আল-শিক্ক, এবং আল-কাতিবা, যেগুলো সম্ভবত মরুময়তা, আগ্নেয়গিরির খাদ এবং জলাধারের মত বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি এলাকাতেই একাধিক দুর্গ এবং আস্তানাসহ বাড়িঘর, গুদামঘর এবং ঘোড়াশাল ছিল। প্রতিটি দুর্গই একেকটি পৃথক পরিবারের অধীনে ছিল এবং আবাদি ফসল ও খেজুরবাগান দিয়ে ঘেরা ছিল। নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করার জন্য তারা পাহাড়ের চুড়ায় অথবা উঁচু পাথুরে এলাকায় তাদের দুর্গগুলো স্থাপন করত।

বনু নাদির

আরও দেখুন: বনু নাদির

৬২৫ সালে মুসলিমদের দ্বারা মদিনা থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর, বনু নাদির গোত্র খাইবার ময়দানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে খন্দকের যুদ্ধের সময় বনু নাদির গোত্রের প্রধান হুয়াই ইবনে আখতাব তার পুত্রকে সাথে নিয়ে মক্কাবাসী এবং মদিনা বিরোধী বেদুঈনদের সাথে যোগ দেয়।উপরন্তু নাদির গোত্র অন্যান্য আরব গোত্রকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অর্থও প্রদান করে। এছাড়াও তারা বনু গাতাফান গোত্র থেকে ফসলের অর্ধাংশ ঘুষ নিয়ে তাদের ২০০০ পুরুষ এবং ৩০০ ঘোড়া সওয়ারীকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেয় এবং একইভাবে বনি আসাদ গোত্রকেও ধোঁকা দিয়ে রাজি করে। বনু সুলাইম গোত্রকেও তারা যুদ্ধে পাঠানোর জন্য উদ্যোগ নেয়, কিন্তু সুলাইম গোত্রের কিছু নেতা ইসলাম ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কারণে তারা তাদেরকে মাত্র সাতশত জন সেনা প্রদান করে। বনু আমির গোত্র মুহাম্মাদ সা. এর সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকার কারণে সম্যকভাবে যুদ্ধে যোগদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, হুয়াই ইবনে আখতাব বনু কুরাইজা গোত্রকে চুক্তিভঙ্গ করে মুহাম্মাদ সা. এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্ররোচিত করে।যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর পরাজয় এবং বনু কুরাইজার আত্মসমর্পণের পর, হুয়াইকে (যে কিনা সেই সময়ে কুরাইজাদের দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিল) এবং কুরাইজার পুরুষদেরকে হত্যা করা হয়। হুয়াইয়ের মৃত্যুর পর, আবু আল-রাফি ইবনে আল-হুকাইক খাইবারের বনু নাদির গোত্রের দায়িত্ব নেয়। অল্প সময় পরই হুকাইক মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রস্তুত করার অন্য প্রতিবেশী গোত্রগুলোর সাথে যোগাযোগ শুরু করে। এ ঘটনা জানার পর, মুসলিমগণ ইহুদিদের ভাষাভাষী এক আরবের সহায়তা নিয়ে হুয়াইকে গোপনে হত্যা করে।

এরপর হুকাইকের স্থলাভিষিক্ত হন উসাইর ইবনে যারিম। একটি সূত্রে বলা হয়েছে যে,উসাইর গাতাফান গোত্রের সাথে সলাপরামর্শ শুরু করেছিল এবং গুজব ছড়ায় যে সেও “মুহাম্মাদের রাজধানী” মদিনা আক্রমণের অভিপ্রায়ে ছিল। এই খবর পেয়ে নবী মুহাম্মাদ সা. আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাকে আব্দুল্লাহ ইবনে উনাইস, বনু সালিমা গোত্রের একজন সদস্য এবং ইহুদি বিরোধী একটি গোত্রসহ আরও অনেককে সাথে নিয়ে উসাইরের কাছে প্রেরণ করেন। তারা উসাইরকে বলেন যে, সে মুহাম্মাদ সা. এর কাছে গেলে মুহাম্মাদ সা. তার সাথে সাক্ষাৎ কড়বেন এবং তাকে সম্মান দেবেন”। সে রাজি না হওয়া পর্যন্ত তারা তাকে অনুরোধ করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সে কিছু ইহুদিকে সাথে নিয়ে তাদের সাথে রওয়ানা হয়”। খাইবার থেকে ছয় মাইল দুরে কারাড়া নামক স্থানে আসার আগ পর্যন্ত উসাইর স্বাভাবিক ছিলেন, আচমকা তিনি তাদের সাথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন। উসাইর আবদুল্লাহর তলোয়ার কেড়ে নিতে উদ্যত হলে আবদুল্লাহ তার দিকে ছুটে এসে তার পা কেটে দেন”। আবদুল্লাহকে উসাইর তার হাতে থাকা কাঠের লাথি দিয়ে আঘাত করলে তিনি মাথায় চোট পান। এরপর সেখানে উপস্থিত মুসলিমগণ তার ৩০ জন ইহুদি সঙ্গীর মাঝে সকলকে হত্যা করে একজনকে বাদে যে কিনা দৌড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।এছাড়াও আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস খাইবার যুদ্ধের আগের দিন মুহাম্মাদ সা. এর অনুমতিতে স্বেচ্ছায় বনু নাদির গোত্রের সাল্লাম ইবনে আবু আল-হুকাইককে গোপনে হত্যা করেন।

অনেক ইসলামী পণ্ডিত উপরে উল্লেখিত চক্রান্তসমূহকে খায়বার যুদ্ধের কারণ বলে মনে করেন। মন্টগোমারি ওয়াটের বক্তব্য অনুযায়ী, তাদের এই কুচক্রী প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে মুহাম্মাদ সা. এর কাছে আক্রমণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। ভ্যাগ্লিয়েরি আরও যোগ করেন যে, আক্রমণের আরেকটি কারণ হতে পারে যে “, খাইবারের এই ইহুদিরাই উহুদের যুদ্ধে চুক্তিতে আবদ্ধ মিত্রবাহিনীর বিরোধিতার জন্য দায়ী ছিল”।শিবলী নোমানীও ভ্যাগ্লিয়েরির সাথে ঐকমত্য্য পোষণ করেন, এবং তিনি বনু নাদির গোত্রের হুয়াই ইবনে আখতাবকে এর জন্য দায়ী করেন”, যে কিনা বনু কুরাইযা গোত্রকে খন্দকের যুদ্ধে মুহাম্মাদ সা. এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্ররোচিত করেছিল।

হুদায়বিয়ার সন্ধি

আরও দেখুন: হুদায়বিয়ার সন্ধি

৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এবং তার সাহাবিরা মক্কায় উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে রওনা হলে কুরাইশদের সাথে আলোচনা ও আপোসের পর একটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হয়। এটি “হুদাইবিয়ার সন্ধি” নামে পরিচিত। এই চুক্তির মাধ্যমে কুরাইশ ও মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, কুরাইশরা মুসলমানদেরকে তাদের ভবিষ্যৎ অভিযানে কোনো প্রকার আক্রমণ করবে না বলে নিশ্চয়তা প্রদান করে।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি

মুহাম্মাদের সাথে যুদ্ধ আসন্ন বলে মনে হওয়ায় খায়বারের ইহুদিগণ ফাদাক মরুভূমির ইহুদিগণের সাথে একটি মৈত্রীবন্ধন বা জোট স্থাপন করে। এছাড়াও তারা বেদুঈন গাতাফান গোত্রকেও ফসলের অর্ধেক প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুদ্ধে তাদের পক্ষে যোগ দেয়ার জন্য রাজি করিয়ে ফেলে। যাই হোক, উক্ত তিন শক্তির তুলনায় মুহাম্মাদের সৈন্যবাহিনীকে খায়বারবাসীর মুকাবেলা করার জন্য সেরকম শক্তিশালী ও প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছিল না। মুহাম্মাদের সেনাবাহিনী ছোট জানতে পেরে তারা আসন্ন যুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য সাংগঠনিক প্রস্তুতি নেয়া প্রায় বন্ধই করে দিল, তাছাড়া তাদের পরিবারগুলোর মধ্যে চলমান পূর্ববর্তী ঝগড়া তাদেরকে তাদেরকে পূর্বের মতই বিশৃঙ্খল করে রাখল।বনু গাতাফানের সাথে সংশ্লিষ্ট গোত্র বনু ফাজারাও মুসলিমদের সাথে সন্ধি স্থাপনে ব্যর্থ হওয়ার পর” খায়বারবাসীকে যুদ্ধে সহায়তা প্রদানের প্রস্তাব করে”।

বনু গাতাফান গোত্রের ব্যর্থতা

যুদ্ধ চলাকালে, মুসলিমগণ গাতাফান গোত্রকে খায়বারবাসীর সহায়তায় ৪০০০ সেনা প্রদান করার গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়। এর একটি কারণ হিসেবে মনে করা হয় যে, মুসলিমগণ ইহুদিদের বেদুঈন মিত্রদের অর্থ দিয়ে কিনে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাশাপাশি ওয়াট আরও দাবি করেন যে, গাতাফানদের দুর্গে মুসলিমদের হামলা করার গুজবও এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। তাবারির মতে, খায়বার যুদ্ধে মুহাম্মাদ আল রাযী উপত্যকায় প্রথম যাত্রাবিরতি করেন। টানা এক দিন সফরের পর গাতাফানের লোকেরা মুসলিম বাহিনীর আগমন টের পায় এবং নিজ পরিবার ও সম্পদ রক্ষা করার জন্য খায়বারবাসীকে সাহায্যের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে, যা মুহাম্মাদের সেনাবাহিনীর বিজয়ের পথকে আরও প্রশস্ত করে দেয়।আরেকটি বর্ণনা প্রচলিত আছে যে, একটি রহস্যময় কণ্ঠ গাতাফান গোত্রকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে তাদেরকে নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রভাবিত করে।


যুদ্ধের ক্রমোন্নতি

৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে, অর্থাৎ ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে মুসলিমগণ খাইবার যুদ্ধের জন্য রওয়ানা হয়।বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, সে সময় মুসলিম বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১৪০০ থেকে ১৮০০ জন এবং সাথে ঘোড়া ছিল ১০০ থেকে ২০০ টি। উম্মে সালামা সহ বেশ কিছু মুসলিম মহিলা আহত সৈন্যদের দেখাশুনা করার জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। খায়বারের ১০০০০ সৈন্যের তুলনায় মুসলিম সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল নগণ্য, কিন্তু এই নগণ্য সদস্য সংখ্যাই মুসলিমদের সুবিধা করে দিয়েছিল। স্বল্প সংখ্যক হওয়ার কারণেই মুসলিমগণ নীরবে ও দ্রুতবেগে খায়বারের দিকে মাত্র তিনদিনের মধ্যে অগ্রসর হয়ে আকস্মিকভাবে নগরীতে প্রবেশ করতে পেরেছিল। এছাড়া বৃহৎসংখ্যক সৈন্য খাইবারবাসীকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল।ফলস্বরূপ, ইহুদিগণ কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত হয়ে মুসলিমদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়, এবং ইহুদি পরিবারগুলোর হাতে নিজ নিজ দুর্গ রক্ষা করার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়।খাইবারের ইহুদিগণ মুসলিমদের শক্তিকে ছোট করে দেখার কারণেই মুহাম্মাদের পক্ষে আপেক্ষিক স্বচ্ছন্দে একটির পর একটি করে প্রতিটি দুর্গ জয় করা সহজ হয়ে গিয়েছিল, এবং সাথে খাদ্য, যুদ্ধাস্ত্র এবং পারিপার্শ্বিক জমিসমূহ দখলও।আনাস ইবনে মালিক বলেন:”আমরা খায়বারে পৌঁছে দেখতে পেলাম সকাল বেলা খাইবারের শ্রমিকরা কোদাল ও ঝুরি নিয়ে দিনের কাজে বেরুচ্ছিল। “রাসূলুল্লাহ ও তাঁর বাহিনিকে দেখে তারা সবিস্ময়ে বলে উঠলো, “সর্বনাশ! মুহাম্মাদ তার বাহিনীসহ হাজির হয়েছে দেখছি”- বলেই তারা পালিয়ে পেছনে ফিরে যেতে লাগলো”। সে দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ বললেন, “আল্লাহু আকবার! খাইবাড়ের পতন ঘটেছে।”আমরা কোন জনপদে আগমন করলেই তার অধিবাসীর সকাল বেলাটা দুর্ভাগ্যময় হয়ে ওঠে।”

কোন একটি দুর্গের সম্মুখে একটি উল্লেখযোগ্য রক্তক্ষয়ি দাঙ্গার পর ইহুদিগণ প্রকাশে লড়াই এড়িয়ে যায়”।” লড়াইয়ের অধিকাংশ অংশই অনেক দূর থেকে তির নিক্ষেপণের মাধ্যমে চালিয়ে যাওয়া হয়”। প্রতিটি দুর্গেই মুসলিমগন কমপক্ষে একবার করে আক্রমণ করে”। অবরুদ্ধ ইহুদিদের দুর্গের প্রতিরোধ ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত দুর্বল হওয়ার কারণে তারা অন্ধকাড়ের আশ্রয় নিয়ে দুর্গের লোকজনকে মালামালসহ এক দুর্গ থেকে আরেক দুর্গে সরিয়ে নেয়।

ইহুদি এবং মুসলিমগণ কেহই এই দীর্ঘ সময়ের অবরোধের জন্য প্রস্তুত ছিল না, এবং এই অপরিণামদর্শিতার কারণে উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমদিকে ইহুদিগণ তাদের লোকবল নিয়ে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হওয়ার কারণে একটি ক্ষুদ্র অবরোধের মধ্যে পরিমাণমত পানি সরবরাহ করতেও ব্যর্থ হয়। অভিযানের শুরুর দিকে ক্ষুধার্ত মুসলিমগণ তাদের ক্ষুধা মেটাতে যুদ্ধের প্রয়োজনে নিয়ে আসা কিছু গাধা জবাই করতে বাধ্য হয়।” পূর্বে মুহাম্মাদ ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধার গোশত খেতে নিষেধ করলেও উক্ত পরিস্থিতিতে একটি বতিক্রম নিতি প্রদান করেন যে, “কোন পরিস্থিতিতে যদি কোন হালাল খাদ্য পাওয়া না যায় তবে জীবন বাঁচানোর তাগিদে কোন ব্যক্তির জন্য নিষিদ্ধ খাদ্যসমূহ খাওয়া বৈধ হবে।

কামুস দুর্গের পতন

নাতাত ও শিক দুর্গ দখলের পর মুসলিম বাহিনীর জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল কামুস দুর্গের অবরোধ। এই দুর্গটি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং প্রহরায় কঠোরভাবে রক্ষিত। মুসলিম বাহিনী মোট ১৩ থেকে ১৯ দিন পর্যন্ত এই দুর্গটি অবরোধ করে রাখে।

খায়বার অভিযানের সময় কামুস দুর্গ দখলের জন্য মুসলিম বাহিনী একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালায়। প্রথমে আবু বকর সিদ্দীক (রা.) এবং পরের দিন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-কে পাঠানো হয়, তবে তাদের প্রচেষ্টায় দুর্গ দখল সম্ভব হয়নি। অবশেষে, নবী মুহাম্মাদ (সা.) ঘোষণা দেন যে, তিনি পরদিন এমন একজনকে পতাকা দেবেন যিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসেন এবং আল্লাহ তার মাধ্যমেই দুর্গ জয় করাবেন।

পরদিন তিনি আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-কে ডাকেন। আলী (রা.) তখন চোখের রোগে ভুগছিলেন। নবী (সা.) তার চোখে থুতু লাগিয়ে দেন, এবং আলী (রা.) সুস্থ হয়ে যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে যান। তিনি প্রচণ্ড সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে দুর্গের দিকে অগ্রসর হন এবং একপর্যায়ে দুর্গের নিচে পতাকা স্থাপন করেন। এক ইহুদী তাকে দেখে জানতে চাইলে আলী (রা.) পরিচয় দেন, এবং ইহুদী বলে ওঠে যে, “তাওরাতের শপথ! তোমরা বিজয়ী হয়েছো।”

যুদ্ধ চলাকালে এক ইহুদির আঘাতে আলী (রা.) তার ঢাল হারান, এবং বিকল্প হিসেবে দুর্গের একটি ভারী দরজা তুলে ঢালের মতো ব্যবহার করেন। বলা হয়, এই দরজা এত ভারী ছিল যে পরবর্তীতে এটি উঠাতে আটজনের প্রয়োজন হয়েছিল। শিয়া সূত্র অনুযায়ী, আলী (রা.) দরজাটি ছুঁড়ে এমনভাবে ফেলে দেন, যা দুর্গের উপর একটি সেতুর মতো তৈরি করে, এবং মুসলিম বাহিনী এই সেতুর মাধ্যমে দুর্গে প্রবেশের সুযোগ পায়।

এই বিজয়ে নবী মুহাম্মাদ (সা.) আলীকে “আসাদুল্লাহ” বা “আল্লাহর সিংহ” উপাধিতে ভূষিত করেন, যা সাহাবীদের মনোবল ও আস্থা বাড়িয়ে তোলে।

খায়বার অভিযানে ইহুদিরা আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাথে আলোচনা করতে আসে। আল-ওয়াতি এবং আল-সুলাইম গোত্রের লোকেরা মুসলিম বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এই শর্তে যে, মুসলিমরা তাদের প্রতি সদয় আচরণ করবে এবং তাদের রক্তপাত থেকে বিরত থাকবে। নবী মুহাম্মাদ (সা.) তাদের এই শর্তসমূহ মেনে নেন এবং ঐ দুই দুর্গ থেকে কোনো মালামাল বা সম্পদ অধিগ্রহণ করেননি।

মারহাবকে হত্যা

ঐতিহাসিকগণ খায়বারের ইহুদি যোদ্ধা মারহাবের নিহত হওয়ার ঘটনাটি বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। কিছু উৎসে বলা হয়েছে, কামুস দুর্গ বা নাইম দুর্গ দখলের সময় আলী ইবনে আবি তালিবের হাতে মারহাব নিহত হন। তবে ইবনে হিশাম রচিত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনীসহ আরও কিছু সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে সাহাবী মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা নবী মুহাম্মাদের নির্দেশে মারহাবকে হত্যা করেন এবং এই ঘটনা কামুস দুর্গ দখলের আগেই ঘটে।

আলীর সাথে সম্পর্কিত বহুল প্রচলিত বর্ণনাটি নিম্নরূপ:

খায়বারের যুদ্ধ
আলী মারহাবকে হত্যা করছেন, একটি প্রাচীন পারস্য চিত্রায়ন।

আলী কামুসের দরজায় এসে পৌঁছুলে ইহুদিদের অন্যতম দলপ্রধান এবং অভিজ্ঞ যোদ্ধা মারহাব তার সাথে দেখা করল। মারহাব বলে উঠলো: “খায়বার খুব ভাল করেই জানে যে আমি মারহাব, যার অস্ত্র ক্ষুরধার ও যুদ্ধের জন্য পরিক্ষিত। কখনো আমি বর্শা দ্বারা বিদ্ধ করি, কখনোবা তরবারি দ্বারা আঘাত করি, যখন আমার অগ্নিসম ক্রোধ সিংহের মত খেপে ওঠে।”

উভয় যোদ্ধাই একে অপরকে আঘাত করলেন। দ্বিতীয় আঘাতের পর আলী তরবারি দিয়ে মারহাবের মস্তকবর্ম দু’টুকরো করে মাথা চিরে ফেললেন, এবং তার তরবারি মারহাবের দাঁতে গিয়ে ঠেকল।

সহিহ মুসলিমেও উক্ত বর্ণনাটির উল্লেখ রয়েছে এভাবে: রাসুলুল্লাহ আলীর হাতে পতাকা দিলেন। এবারো মুরাহহাব (মারহাব) বেরিয়ে এল এবং কবিতা আওড়াতে লাগল “ খায়বার জানে যে, আমি মুরাহহাব, যুদ্ধের অস্ত্রে সজ্জিত এক অভিজ্ঞতাপূর্ণ বীর বাহাদুর ব্যক্তি। যখন যুদ্ধ তাঁর লেলিহান শিখা নিয়ে অগ্রসর হয়, তখন আলী বললেন, “আমি সে ব্যক্তি যাকে আমার মা ‘হায়দার’ (সিংহ) নাম রেখেছেন, যার দর্শন বন্য সিংহের মত ভয়ঙ্কর। আমি তাদের (দুশমনদের) প্রতিদান দেই বড় বড় পাত্র দিয়ে (অর্থাৎ তাদের অবলীলায়) হত্যা করি”। এরপর তিনি মুরাহহাবের মাথায় তলোয়ার মারলেন এবং তাকে হত্যা করলেন।

“ইবনে হিশামের সিরাত থেকে প্রাপ্ত মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা সম্পর্কিত বর্ণনাটি নিম্নরূপ:”

“এক এক করে খাইবারের কিল্লাগুলো এবং তাদের ধনসম্পদ রাসূলুল্লাহ -এর হস্তগত হচ্ছিল। কেবল ওয়াতীহ ও সুলালিম নামক কিল্লা দুটি দখল করা তখনও বাকী ছিল। সবশেষে তিনি এ দুটি কিল্লা জয় করেন। এ দুটিকে তিনি দশদিনের অধিক সময় ধরে অবরোধ করে রাখেন।

ইয়াহুদ নেতা মরারহাব অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে মুহাম্মাদের মুকাবিলায় এগিয়ে এসে একটি রণোদ্দীপক কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলো। কবিতাটি হলোঃ

“সমগ্র খাইবার জানে যে, আমি মারহাব। (অর্থাৎ খুব প্রতাপশালী)

অস্ত্র দিয়ে আঘঅত করতে পারদর্শী,” অভিজ্ঞ ও বহুদর্শী বীর।

কখনো এফোঁড় ওফোঁড় করে দিই আবার কখনো শক্ত আঘাত করি।

শার্দুলেরা যখন ক্রুদ্ধ হয়ে ধেয়ে আসে তখন আমার ধারে কাছেও

কেউ ঘেঁষতে পারে না।”

সে চ্যালেঞ্জ করলো,, “এসো আমাড় সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধ কড়তে কে প্রস্তুত আছ?” কা’ব ইবনে মালিক রনসংগীত আবৃত্তি করেই তার জবাবে বললেন,”

“খাইবার জানে যে আমি কা’ব।” আমি দুঃখ দুর্দশা ঘুচাই, সাহসী ও অনমনীয়”।

যখন যুদ্ধ বেঁধে যায় তখন” যুদ্ধের পর যুদ্ধই চলতে থাকে।

আমার আছে বিজলীর আলোকচ্ছটার মত ধারালো তরবারীটা।

আমরা তোমাদেরকে পদদলিত করবো যাতে সব জটিলতাড় অবসান ঘটে।

এতে আমরা পুরস্কৃত হবো অথবা আমাদের কাছে

প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ চলে আসবে! (সে সম্পদ আসবে) বজ্রমুষ্ঠির আঘাতে

এবং তাতে কোন তিরস্কারের অবকাশ থাকবে না।”

মুহাম্মাদ বললেন, “এই লোকটির সাথে কে লড়তে প্রস্তুত আছে?” মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি তার সাথে লরতে প্রস্তুত আছি। আল্লাহর কসম, আমি ভীষণ লড়াকু। আমি ওর থেকে স্বজন হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাই। গতকাল সে আমার ভাইকে (মাহমুদ ইবনে মাসলামা) হত্যা করেছে।” মুহাম্মাদ বললেন “যাও। হে আল্লাহ, মারহাবকে পর্যুদস্ত করতে ওকে সাহায্য কর।” অতঃপর মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা ও মারহাবকে মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। একটি পুরনো বৃক্ষ তাদের মাঝখানে আড় হয়ে দাঁড়ালো। উভয়ে পালাক্রমে ঐ গাছের আড়ালে আশ্রয় নিতে লাগলো। এক সময় মারহাবের তরবাড়ি মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামার ঢালে আটকে গেল”। তৎক্ষণাৎ মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা তরবারীর আঘাতে মরহাবকে হত্যা করলেন”।

যদিও, এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন সন্দেহ নেই যে, মুহাম্মাদ বিন মাসলামাও খায়বারের যুদ্ধে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন এবং বেশ কিছু প্রসিদ্ধ ইহুদি নেতাকে হত্যা করেন।


ফলাফল

নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) খাইবারবাসীকে তাদের দুই দুর্গ ওয়াতীহ ও সুলালিমে অবরোধ করলেন। যখন তারা নিশ্চিতভাবে বুঝলো যে মৃত্যু ছাড়া আর কোন উপায় নেই তখন তারা তার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইল এবং খাইবার থেকে তাদেরকে বহিস্কার করার প্রস্তাব দিল। নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এ প্রস্তাব মেনে নিলেন ও প্রাণভিক্ষা দিলেন। ইতঃপূর্বেই তিনি তাদের আশঙ্কা আন্ নাতাহাহ ও আল কুতাইবার ভূমিসহ সমস্ত স্থাবর অস্থঅবর সম্পদ এবং ঐ দুটি দুর্গ ছাড়া সকল দুর্গ অধিকার করে নিয়েছিলেন। ফদাকবাসী যারা যুদ্ধের সময় খায়বারের মিত্র ছিল, তারা সমস্ত খবর জানতে পারলো। তারা মুহাম্মাদ কে তাদের প্রাণভিক্ষা দিয়ে বিতাড়িত করণ এবং জমিজমা ও ধনসম্পদ হস্তগত করার অনুরোধ জানালো। মুহাম্মাদ তাদের অনুরোধ গ্রহণ করলেন। ইয়াহুদীদের পক্ষ থেকে যারা এই অনুরোধ নিয়ে মুহাম্মাদ র নিকট গিয়েছিল তাদের মধ্যে মুহাইসা ইবনে মাসউদ ছিলো অন্যতম। সে ছিল বনু হারেসার লোক। খাইবারবসী এই ব্যবস্থা প্রথমে মেনে নেয়। কিন্তু পরে অনুরোধ করে যে আমাদেরকে বহিস্কার না করে অর্ধেক বর্গাভাগের ভিত্তিতে জমি চাষের কাজে নিয়োজিত করুন। তারা যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলে যে এখানকার জমিজমা আমরাই ভাল আবাদ করতে সক্ষম এবং এ কাজে আমরাই সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী। মুহাম্মাদ এ প্রস্তাব মঞ্জুর করে তাদের সাথে আপোষরফা করলেন। তবে শর্ত আরোপ করলেন যে, আমরা ইচ্ছা করলেই তোমাদেরকে উচ্ছেদ করার অধিকার আমাদের থাকবে। ফাদাকবাসীও এই শর্তে তার সাথে আপোস করলো। এভাবে খায়বারবাসীর ন্যায় ফাদাকবাসীদের সাথেও একটি সন্ধিচুক্তি করা হল এবং খাইবার মুসলামানদের যৌথ সম্পদ এবং ফাদাক মুহাম্মাদ র ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হলো। কেননা ফাদাক জয় করতে সামরিক অভিযানের প্রয়োজন পড়েনি।[৩৮]

‘কামূস’ দুর্গ বিজয়কালে মুহাম্মাদ কিছুসংখ্যক ইয়াহুদীকে আটক করেন। তাদের মধ্যে হুয়াই ইবনে আখতাবের কন্যা সাফিয়া অন্যতম। সে বনু নাদির গোত্রের কোষাধ্যক্ষ কিনানা ইবনে রাবীর স্ত্রী ছিল। তার দু’জন চাচাতো বোনও গ্রেফতার হয়। সাহাবীগণ নবীর কাছে সাফিয়াকে গ্রহণ করার অনুরোধ করলে মুহাম্মাদ সাফিয়াকে নিজের জন্য মনোনীত করেন এবং তাঁকে দাসত্ব হতে মুক্তি দিয়ে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।[৪৬] দাহইয়া ইবন খালীফা কালবী মুহাম্মাদ র নিকট সাফিয়াকে চেয়েছিলেন। তিনি সাফিয়াকে নিজের জন্য গ্রহণ করে নিয়েছিলেন বলে দাহইয়াকে তার চাচাতো বোনকে দিয়ে দেন। ক্রমে খাইবারের গ্রেফতারকৃত লোকদেরকে সাহাবীদের সকলের মধ্যে বণ্টন করা হয়।

কেনানা ইবনে রাবিকে প্রশ্ন করা হয় যে, মদিনা প্রস্থানের সময় তারা যে গুপ্ত সম্পদ নিয়ে গিয়েছিল তা কোথায় রেখেছে, তিনি উত্তরে ওই সম্পদের দাবি অস্বীকার করেন। তাকে বলা হল যে, যদি সেরকম কোন সম্পদ খুঁজে পাওয়া যায়, তবে মিথ্যে দাবির শাস্তিস্বরূপ তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। কেনানা তাতে রাজি হলেন। এরপর কোন এক সময় এক ইহুদি মুহাম্মাদ কে বললেন যে, লা রাবিকে প্রতিদিন সকালে একটি নির্দিষ্ট স্থানে দেখা যেতো। যখন ওই স্থানটি খোঁড়া হল, তখন সেখানে ওই সম্পদের কিছু অংশ পাওয়া গেল। ফলশ্রুতিতে কেনানা মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হল।[৪৬][৪৭][৪৮] শিবলী নোমানী এই বর্ণনাকে অস্বীকার করে দাবি করেন যে, কেনানাকে হত্যা করা হয়েছিল কারণ পূর্বে সে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামার ভাই মাহমুদ ইবনে মাসলামাকে হত্যা করেছিল।[৪৯] কিন্তু আল ওয়াকিদির বর্ণনার সাথে নোমানীর এই দাবির পরস্পরবিরোধিতা খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয় মারহাব নিজে নিহত হবার অল্প কিছুদিন আগে মাহমুদকে হত্যা করেছিলেন।

আপোষরফার পর সাল্লাম ইবনে মুসকামের স্ত্রী যায়নাব বিনতে হারেস তাঁকে একটি ভুনা বকরী উপহার দিল। ভুনা ছাগলটি পাঠানোর আগে সে জিজ্ঞেস করে, “রাসূলুল্লাহ বকরীর কোন্ অংশ খেতে বেশি পছন্দ করেন?” তাকে জানানো হলো যে, “তিনি উরু বা রানেড় গোশত বেশি পছন্দ করেন। তখন সে উরুতে বেশি করে বিষ মিশিয়ে দেয়। অতঃপর পুড়ো ছাগলটিকে মুহাম্মাদ র নিকট নিয়ে আসে”। তা থেকে মুহাম্মাদ এক টুকরো গোশত চিবালেন কিন্তু গিললেন না”। সাহাবী বিশর ইবনে বারা ইবনে মা’রুরও তাঁর সাথে বসে খাচ্ছিলেন। বিশরও এক টুকরো গোশত মুখে নিয়ে চিবালেন। তিনি গেলে ফেললেন। কিন্তু মুহাম্মাদ উগরিয়ে ফেলে দিলেন। তিনি বললেন, “এই হড্ডিটা আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তা বিষাক্ত।” অতঃপর তিনি মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন। সে স্বীকারোক্তি করলো। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এমন কাজ কেন করলে?” সে বললো, “আপনি আমার কওমের সাথে কি আচরণ করেছেন তা আপনার জানা আছে। আমি ভাবলাম আপনাকে এভাবে বিষ খাওয়াবো। আপনি যদি কোন রাজা-বাদশাহ হয়ে থাকেন তাহলে আপনার হাত থেকে উদ্দার পাবো আর যদি নবী হয়ে থাকেন হাহলে তো আপনাকে (আল্লাহর তরফ থেকে) সাবধান করে দেয় হবে।” এ কথা শুনে মুহাম্মাদ তাকে মাফ করে দিলেন। কিন্তু বিশর যে টুকরাটি খেয়েছিলেন তাতেই তিনি মারা গেলেন।খাইবার বিজয় সম্পন্ন করার পর মুহাম্মাদ ওয়াদিউল কুরাতে চলে গেলেন। সেখানকার অধিবাসীদের কয়েকদিন অবরোধ করে রাখেলেন, অতঃপর মদীনা চলে গেলেন।

খায়বার বিজয়ের কারণে সাহাবীগণ এবং স্থানীয় বেদুঈন গোত্রগুলোর কাছে মুহাম্মাদের মর্যাদা অনেক বেড়ে যায়। স্থানীয় বেদুঈনগণ মুহাম্মাদের ক্ষমতা অনুধাবন করে তার আনুগত্য স্বীকার করে এবং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। খায়বার যুদ্ধের যুদ্ধলব্ধ মালামাল এবং অস্ত্রসমূহ তার সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে,” এবং খায়বার বিজয়ের মাত্র ১৮ মাস পরেই মুহাম্মাদ মক্কা দখল করতে সক্ষম হন।


প্রাচীন ইসলামী সাহিত্যে খায়বারের যুদ্ধ

মূলধারার সুন্নিদের মতামত অনুযায়ী, “সহিহ বুখারি গ্রন্থে খায়বার যুদ্ধেড় কথা উল্লেখ করা হয়েছে, “যেখানে মুহাম্মাদ কে বলতে দেখা যায়: “কাল আমি এমন একজনকে পতাকা দেবো যার নেতৃত্বে আল্লাহ (মুসলিমদের) “বিজয় দান করবেন।” এরপর, তিনি আলীকে পতাকা দিলেন। শিয়া বর্ণনা অনুসারে, মুহাম্মাদ আলীকে নির্বাচিত করলেন, যিনি কোন এক ইহুদি সর্দারকে তরবারির আঘাতে মস্তকবর্মের ভেতর দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দু টুকরো করে তাকে হত্যা করলেন। আরও বলা হয় যে, নিজের ঢাল হারিয়ে ফেলার পর, আলী দুর্গের দুটি দরজাই কব্জা থেকে তুলে নিয়ে দুর্গের খাদ বেয়ে উঠে সাহাবীদেরকে তা দিয়ে একটি সেতু বানাতে সাহায্য করলেন যার ফলে মুসলিমগণ দুর্গে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। দরজাটি এতোই ভারি ছিল যে পুনরায় কব্জায় বসানোর জন্য চল্লিশ জন লোক মিলে তা তুলে ধরতে হয়েছিল। এই ঘটনাটির উপর ভিত্তি করেই মূলত শিয়াগণ আলীর প্রতি একজন আদর্শ বীরের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকেন”।

সেই সময়ে, মুসলিম সৈন্যগণ মুহাম্মাদের মতামত ও অনুমতি ছাড়াই খামার থেকে পালিয়ে আসা একপাল গাধাকে মেরে রান্না করে খান। এই ঘটনার ফলে মুহাম্মাদ বৈধ খাদ্যের অভাব ব্যতীত ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধার মাংস খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রবর্তন করেন। টানা দেড় মাস ব্যাপী অবরোধের পড় ইহুদিগণ আত্মসমর্পণ করে এবং মুসলিমগণ দুটি বাদে সকল দুর্গ দখল করে নেন।


প্রাথমিক ইসলামী সূত্র

মুসলিম পণ্ডিতগণ ধারণা কড়েন যে ইসলামী কেন্দ্রীয় ও প্রধান ধর্মগ্রন্থ কুরআনের নিম্নোক্ত অংশে খাইবার দখলকে একটি ঐশী প্রতিশ্রুতি হিসেবে পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে”

“আল্লাহর তোমাদরকে অঢেল যুদ্ধলব্ধ সম্পদেড় প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যা তোমরা লাভ করবে। তিনি তোমাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিজয় দিয়েছেন।” [কুরআন ৪৮:২০

বহু সুন্নি হাদিস সংকলনে খায়বার যুদ্ধের ঘটনাটি উল্লেখিত হয়েছে। মুসলিম লেখক সাইফুর রহমান মোবারকপুরী উল্লেখ করেন যে, নিম্নোক্ত হাদিসটিতে বর্ণিত আমিরের দুর্ঘটনাজনিত আত্মহত্যার ঘটনাটি খায়বার যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত:

সালামা ইবনুল আকওয়া থেকে তার পিতাড় সূত্রে বর্ণিত: …আল্লাহর কসম! এরপর আমরা তিনরাতের অধিক মদিনায় থাকতে পারিনি। এমনি সময় রাসুলুল্লাহ এর সঙ্গে আমরা খায়বারের দিকে বেরিয়ে পড়লাম। তিনি বলেন, তখন আমার চাচা আমির প্রেরণামূলক কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। আল্লাহর কসম! আল্লাহর অনুগ্রহ না হলে আমরা হিদায়াত পেতাম না, “সাদাকাও দিতাম না আর সালাতও আদায় করতাম না। আমরা আপনার অনুগ্রহ থেকে কখনও বেপরওয়া হতে পারি না, “তাই আপনি আমাদের কদম দৃঢ় রাখুন, যখন আমরা শত্রুদের সম্মুখীন হই” এবং আপনি আমাদের প্রতি প্রশান্তি বর্ষণ করুন। “তারপর রাসুলুল্লাহ বললেনঃ এ ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, আমি আমির। রাসুলুল্লাহ বললেন, তোমার রব তোমাকে ক্ষমা করুন। রাবী বলেন, রাসুলুল্লাহ যখন কারো জন্য বিশেষভাবে দু’আ করতেন সে শহীদ হত। তিনি বলেন, তখন নিজ উটে বসা উমর ইবনুল খাত্তাব দূর থেকে আওয়াজ করে বললেন, ইয়া নাবী আল্লাহ্‌! আমিরকে দিয়ে যদি না আমাদের আরো উপকার করতেন? তিনি বলেন, তারপর যখন আমরা খায়বারে উপস্থিত হলাম, “তখন খায়বার অধিপতি মুরাহহাব (মারহাব) “তরবারি দোলাতে দোলাতে বেরিয়ে এল এবং বলল, “খায়বার জানে যে, আমি মুরাহহাব, পূর্ণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, “অভিজ্ঞতাপূর্ণ এক বীরপুরুষ। রাবী বলেন, আমার চাচা আমির কবিতা আবৃত্তি করতে করতে বললেন, “খায়বার জানে যে, আমি আমির অস্ত্রে শস্ত্রে সুসজ্জিত যুদ্ধে অবতীর্ণ বির বাহাদুর নির্ভীক ব্যক্তি”।

রাবী বলেন, তারপর তাদের মধ্যে আঘাত বিনিময় হল। আমির নিচে থেকে যখন তাকে আঘাত করতে চাইলেন, তখন তা ফিরে এসে তার নিজের উপরই লাগল। আর তাতে তার পায়ের গোছার সংযোগ শিরা কেটে গিয়ে মৃত্যু হল। (রাবী) সালামা বলেন, তখন আমি বেরোলাম। নাবী কারিম এর কয়েকজন সাহাবীকে বলাবলি করতে শুনলাম যে, আমিরের আমল বরবার হয়ে গেছে, সে আত্মহত্যা করেছে। তখন আমি কাঁদতে কাঁদতে নাবী এর নিকট এসে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমিরের আমলগুলি কি বরবার হয়ে গেল? তখন রাসুলুল্লাহ বললেনঃ (একথা) কে বলেছে? রাবী বলেন, আমি বললাম, আপনারই কয়েকজন সাহাবী। তিনি বললেন, যারা এরুপ বলেছে তারা মিথ্যা বলেছে এবং তার প্রতিদান সে দু’বার পাবে।…সহীহ মুসলিম, ১৯:৪৪৫০ (ইংরেজি)

আনাস ইবনু মালিক থেকে বর্ণিত, রাসূল (একদিন) ফজরের সালাত (নামায/নামাজ) অন্ধকার থাকতে আদায় করলেন। এরপর সাওয়ারীতে আরোহণ করলেন এবং বললেনঃ আল্লাহু আকবার, খায়বার ধ্বংস হোক! যখন আমরা কোন সম্প্রদায়ের এলাকায় অবতরণ করি তখন সতর্কীকৃত দের প্রভাত হয় কতই না মন্দ! তখন তারা (ইয়াহূদীরা) বের হয়ে গলির মধ্যে দৌড়াতে লাগল এবং বলতে লাগল, মুহাম্মাদ ও তাঁর খামীস এসে গেছে। বর্ণনাকারী বলেন, খামীস হচ্ছে , সৈন্য–সামন্ত। পরে রাসূল তাদের উপর জয়লাভ করেন। তিনি যোদ্ধাদের হত্যা করলেন এবং নারী-শিশুদের বন্দী করলেন। তখন সাফিয়্যা প্রথমত দিহইয়া কালবীর এবং পরে রাসূল -এর অংশে পড়ল। তারপর তিনি তাঁকে বিয়ে করেন এবং তাঁর মুক্তিদানকে মোহররূপে গণ্য করেন। আবদুল আযীয, সাবিত-এর কাছে জানতে চাইলেন, তাঁকে কি মোহর দেওয়া হয়েছিল, তা কি আপনি রাসূল -কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন? তিনি বললেন, তাঁর মুক্তই তাঁর মোহর, আর মুচকি হাসলেন। সহীহ বুখারী, ২:১৪:৬৮ (ইংরেজি)


সংক্ষিপ্ত পাতা

আরও দেখুন
মুহাম্মাদ (সা.)মুহাম্মাদ, আল্লাহর রাসুল মদিনায় মসজিদে নববীর দরজায় খোদাই করা
খন্দকের যুদ্ধখন্দকের যুদ্ধ
তাবুকের যুদ্ধইসলামে শহীদ তিন প্রকার
হুনাইনের যুদ্ধইসলামে শহীদ তিন প্রকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *