মুসলিমদের উহুদের দিকে যাত্রা।
উহুদের যুদ্ধ (আরবি: غزوة أحد Ġazwat ‘Uḥud) ৩ হিজরির ৭ শাওয়াল, শনিবার (২৩ মার্চ ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ) উহুদ পর্বতের সংলগ্ন স্থানে সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে মদিনার মুসলিম বাহিনী এবং মক্কার কুরাইশ বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এবং কুরাইশদের নেতৃত্বে ছিলেন আবু সুফিয়ান। ইসলামের ইতিহাসে এটি ছিল দ্বিতীয় বড় যুদ্ধ; এর পূর্বে ৬২৪ সালে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল
উহুদের যুদ্ধ | |
---|---|
মূল যুদ্ধ: মুসলিম-কুরাইশ যুদ্ধ | |
সিয়ার-ই নবী গ্রন্থের চিত্রে প্রদর্শিত মুসলিমদের উহুদের দিকে যাত্রা। | |
তারিখ৭ শাওয়াল ৩ হিজরি (২৩ মার্চ ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ)অবস্থানউহুদ পর্বতফলাফলমুসলিমদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় কিন্তু কুরাইশরাও মদিনা দখলে ব্যর্থ হয় | |
বিবাদমান পক্ষ | |
মদিনার মুসলিম | মক্কার কুরাইশ |
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |
মুহাম্মদ (সাঃ) আবু বকর উমর ইবনুল খাত্তাব উসমান ইবনে আফফান আলি ইবনে আবি তালিব হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব মুসআব ইবনে উমাইর মুনজির ইবনে আমর যুবাইর ইবনুল আওয়াম উবাইদা ইবনে সামিত | আবু সুফিয়ান খালিদ বিন ওয়ালিদ ইকরিমা ইবনে আবি জাহল সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া আবদুল্লাহ ইবনে রাবিয়াহ হিন্দ বিনতে উতবা (মহিলাদের সেনাপতি) |
শক্তি | |
৭০০ পদাতিক, ৫০ তীরন্দাজ, ৪টি ঘোড়া | ৩,০০০ পদাতিক, ৩,০০টি উট, ২০০টি ঘোড়া |
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |
৭০ জন শহীদ | ২২-৩৭ জন নিহত |
উহুদের যুদ্ধটি মূলত বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্যে মক্কার কুরাইশদের পক্ষ থেকে সংঘটিত হয়েছিল। বদরের পরাজয়ে ক্ষুব্ধ কুরাইশ বাহিনী মদিনার দিকে অগ্রসর হলে মুসলিমরাও উহুদ পর্বতের পাশে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। প্রথমে মুসলিমরা সফলভাবে কুরাইশ বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে এবং বিজয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
তবে মুসলিম তীরন্দাজদের একটি দল নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ অমান্য করে নির্ধারিত অবস্থান ছেড়ে দেন, যার সুযোগে কুরাইশদের সেনাপতি খালিদ ইবনে ওয়ালিদ পুনরায় আক্রমণ চালান। এই আক্রমণে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং অনেক সাহাবি শহীদ হন। এই যুদ্ধে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও আঘাতপ্রাপ্ত হন। মুসলিমরা পর্বতের দিকে পিছু হটলে কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধে এগিয়ে যায়, তবে মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এরপর ৬২৭ সালে মুসলিমরা এবং কুরাইশরা পুনরায় খন্দকের যুদ্ধে মুখোমুখি হয়, যেখানে মুসলিমরা কৌশলগতভাবে সফল হয়।
পটভূমি
ইসলাম প্রচার শুরু করার পর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নিজ কুরাইশ বংশের মানুষদের দ্বারা কঠোর প্রতিবাদ ও নির্যাতনের সম্মুখীন হন। এই নির্যাতন থেকে বাঁচতে একপর্যায়ে মুসলিমরা মদিনায় হিজরত করে। পরবর্তীতে বদরের যুদ্ধে মক্কার কুরাইশদের বিরুদ্ধে মদিনার মুসলিমরা বিজয়ী হয়, যা ইসলামের ইতিহাসে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বিজয় হিসেবে পরিচিত।
বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের প্রধান নেতাদের অনেকে নিহত হন, যা মক্কার নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে প্রতিশোধের প্রবল ইচ্ছা জাগিয়ে তোলে। এ সময় নিহতদের শোক প্রকাশ করা এবং যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ আদায়ে তাড়াহুড়ো না করার নির্দেশ দেয়া হয়, যাতে মুসলিমরা তাদের দুর্বলতার কথা না জানে। পুনরায় যুদ্ধের জন্য ইকরিমা ইবনে আবি জাহল, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া, আবু সুফিয়ান, এবং আবদুল্লাহ ইবনে রাবিয়াহ নেতৃত্বে প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু হয়।
মক্কার নেতারা এই যুদ্ধের খরচ মেটাতে বদরের সময় রক্ষা পাওয়া আবু সুফিয়ানের কাফেলার সম্পদ বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে। এতে এক হাজার উট এবং পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণমুদ্রার মালামাল ছিল, যা বিভিন্ন গোত্রের সম্মতি নিয়ে সংগ্রহ করা হয়। কুরাইশদের পতাকাতলে বিভিন্ন অঞ্চলের গোত্রগুলিকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়।
মক্কার বাহিনীর অগ্রযাত্রা
মক্কার কুরাইশরা বদরের যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুতি শুরু করে এবং এক বছরের মধ্যে তাদের যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। ৬২৫ সালের ১১ মার্চ, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩,০০০ সৈন্য নিয়ে মক্কার বাহিনী মদিনার দিকে যাত্রা শুরু করে। বাহিনীতে ৩,০০০ উট ও ২০০ ঘোড়া ছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা এবং আরও ১৫ জন নারীও সাথে ছিল। তাদের উপস্থিতি ছিল কুরাইশ যোদ্ধাদের উদ্দীপনা ও সম্মান রক্ষায় বেশি আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করতে।
মদিনায় সরাসরি আক্রমণ না করে, কুরাইশ বাহিনী আকিক উপত্যকা অতিক্রম করে উহুদের নিকটে আয়নাইন অঞ্চলে শিবির স্থাপন করে। এই সময়ে, হিন্দ বিনতে উতবা মুহাম্মাদের মায়ের কবর ধ্বংসের প্রস্তাব করেন। তবে নেতারা এর সম্ভাব্য পরিণামের ভয়ে প্রস্তাবে সায় দেননি।
মদিনার প্রস্তুতি
যুদ্ধযাত্রার খবর মুহাম্মাদের কাছে পৌছায়। এরপর মদিনার বিভিন্ন স্থানে আকস্মিক আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য অনেকে নিয়োজিত হয়।যুদ্ধের জন্য গৃহিতব্য পদক্ষেপ নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় তিনি নিজের দেখা একটি স্বপ্নের কথা জানান। তিনি বলেন,
“আল্লাহর শপথ, আমি একটি ভালো জিনিস দেখেছি। আমি দেখি যে কতগুলি গাভী জবাই করা হচ্ছে। আমি আরও দেখি যে আমার তলোয়ারের মাথায় কিছু ভঙ্গুরতা রয়েছে। আর আমি দেখি যে আমার হাত একটি সুরক্ষিত বর্মে রয়েছে।”
এর ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলেন যে কিছু সাহাবি নিহত হবে, “তলোয়ারের ভঙ্গুরতার অর্থ তার পরিবারের কেউ শহীদ হবে এবং সুরক্ষিত বর্মের অর্থ মদিনা শহর।
পদক্ষেপ নিয়ে মুসলিমদেড় মধ্যে মতপার্থক্য ছিল”। মুহাম্মাদ সহ কারো কারো মত ছিল শহরের ভেতর থেকেই প্রতিরোধ করা”। কারণ মদিনা সুরক্ষিত শহর ছিল এবং প্রতিপক্ষ নিকটবর্তী হলে সহজে তাদের আক্রমণ করা যেত এবং নারীরা ছাদের উপর থেকে ইট পাটকেল ছুড়তে পারত। অন্যদিকে হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবসহ কিছু সাহাবি ভিন্নমত দেন। তাদের দাবি ছিল এভাবে শহরের ভেতর থেকে প্রতিরক্ষা করলে শত্রুর মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং অগ্রসর হয়ে খোলা ময়দানে লড়াই করলে ভবিষ্যতে তারা সহজে আক্রমণ করতে সাহস করবে না।
এর ফলে মদিনার বাইরে গিয়ে শত্রুর মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মুসলিম বাহিনীর মোট সেনাসংখ্যা ছিল ১,০০০। এর মধ্যে ১০০জন বর্ম পরিহিত ছিল এবং ৫০জন ছিল অশ্বারোহী। মুহাম্মাদ মুসলিম বাহিনীকে তিনভাবে বিভক্ত করেন। এগুলি হল, মুহাজির বাহিনী, আউস বাহিনী ও খাজরাজ বাহিনী। এই তিন বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন যথাক্রমে মুসআব ইবনে উমায়ের, উসাইদ ইবনে হুজাইর ও হুবাব ইবনে মুনজির।
প্রায় ১,০০০ মুসলিমের বাহিনি মদিনা থেকে যুদ্ধের জন্য বের হয়”। তারা শাওত নামক স্থানে পৌছানোর পর ইতিপূর্বে শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধে অস্বীকৃতি জানানো আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার ৩০০ অনুসারী নিয়ে দলত্যাগ করে”। এর ফলে ৭০০ সৈনিক নিয়ে মুসলিমরা উহুদের দিকে যাত্রা করে। যাত্রাপথে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি না হওয়ার জন্য ভিন্ন পথ অবলম্বন করা হয় এবং পথপ্রদর্শক আবু খাইসামা এসময় প্রতিপক্ষকে পশ্চিমে ছেড়ে দিয়ে বনি হারিসা গোত্রের শস্যক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে ভিন্ন একটি পথ অবলম্বন করে উহুদের দিকে মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে যান।
এরপর মুসলিমরা উপত্যকার শেষ প্রান্তেড় উহুদ পর্বতে শিবির স্থাপন করে”। এই অবস্থানে মুসলিমদের সম্মুখে ছিল মক্কার বাহিনী ও পেছনে ছিল উহুদ পর্বত এবং মদিনা ও মুসলিম বাহিনীর মধ্যবর্তী স্থানে মক্কার বাহিনী অবস্থান করছিল।
যুদ্ধক্ষেত্রের লড়াই
মুসলিম সেনাবিন্যাস
উহুদ যুদ্ধের সময় মুহাম্মাদ মুসলিম বাহিনীর সুরক্ষার জন্য কৌশলী সেনাবিন্যাস করেন। তিনি ৫০ জন দক্ষ তীরন্দাজের একটি দলকে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের ইবনে নুমানের নেতৃত্বে পাঠান এবং তাদেরকে কানাত উপত্যকার দক্ষিণ পাশে, মুসলিম শিবিরের পূর্বদক্ষিণে ১৫০ মিটার দূরে অবস্থিত একটি ছোট পাহাড়ে (জাবালে রুমাত) অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন।
তীরন্দাজদের এই অবস্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা মুসলিম বাহিনীকে পেছনের গিরিপথ থেকে আসা আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারত এবং বাম পার্শ্বে থেকে যে কোনো শত্রু আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম হতো। এই সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করায় মুসলিম বাহিনী প্রতিপক্ষের চারপাশে আটকে পড়ার ঝুঁকি থেকে মুক্ত ছিল। এছাড়াও, উহুদ পর্বত ডান দিকে অবস্থান করার কারণে এই দিক থেকেও তারা সুরক্ষিত ছিল।
মুহাম্মাদ তীরন্দাজদের নির্দেশ দেন যাতে তিনি নির্দেশ দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তীরন্দাজরা কোনো অবস্থায় তাদের স্থান থেকে সরে না আসে। তিনি নির্দেশ হিসেবে বলেন
তোমরা আমাদের পিছন দিক রক্ষা কড়বে”। যদি তোমরা দেখ যে আমরা মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছি তবুও তোমরা আমাদের সাহায্য কড়ার জন্য এগিয়ে আসবে না”। আর যদি দেখতে পাও যে আমরা গনিমতের মাল একত্রিত কড়ছি তবে তখনও তোমর আমাদের সাথে যোগ দেবে না।
বাকি সৈন্যদের বিভিন্ন ভাগে বিন্যস্ত করা হয়। বাহিনীর ডান পার্শ্বের নেতৃত্ব মুনজির ইবনে আমর ও বাম পার্শ্বের নেতৃত্ব যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে দেয়া হয়। মিকদাদ ইবনে আসওয়াদকে যুবাইরের সহকারী নিযুক্ত করা হয়। বাম পার্শ্বের দায়িত্ব ছিল মক্কার বাহিনীর ডান পার্শ্বের নেতৃত্বে থাকা খালিদ বিন ওয়ালিদের অশ্বারোহীদের প্রতিরোধ করা। এছাড়াও সম্মুখসারিতে দক্ষ সৈনিকদের নিযুক্ত করা হয়।
মক্কাবাহিনীর সেনাবিন্যাস
উহুদ যুদ্ধের সময় মক্কার বাহিনীর সেনাবিন্যাস ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত। বাহিনীর মূল অংশের নেতৃত্বে ছিলেন আবু সুফিয়ান, যিনি বাহিনীর কেন্দ্রস্থলে তার অবস্থান স্থাপন করেন। বাহিনীর বাম এবং ডান প্রান্তের দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে ইকরিমা ইবনে আবি জাহল ও খালিদ বিন ওয়ালিদ।
পদাতিক ও তীরন্দাজদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া এবং আবদুল্লাহ ইবনে রাবিয়াহ। মক্কার বাহিনীর রীতি অনুযায়ী, বনু আবদ আদ-দার গোত্রের একটি বিশেষ দল তাদের পতাকা বহন করছিল, যা তাদের ঐতিহ্যের অংশ এবং বাহিনীর মনোবল ও সাহস বৃদ্ধির একটি প্রতীক ছিল।
যুদ্ধের সূচনা
উহুদের যুদ্ধে, মক্কার নেতাদের নেতা আবু সুফিয়ান মদিনার আনসারদের উদ্দেশ্যে এক প্রস্তাব পাঠান। তার প্রস্তাব ছিল যদি আনসাররা মুহাজির মুসলিমদের সমর্থন ত্যাগ করে, তবে তাদের কোনো ক্ষতি করা হবে না এবং মদিনা শহরও আক্রমণের বাইরে থাকবে। তবে আনসাররা এই প্রস্তাবকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে এবং মুসলিম ঐক্য বজায় রাখার পক্ষে অবস্থান নেয়।
উহুদের যুদ্ধের শুরুতেই মদিনা ত্যাগী আবু আমর মক্কার পক্ষে প্রথম আক্রমণ চালান। কিন্তু মুসলিমদের তীব্র তীরের আঘাতে তিনি এবং তার লোকেরা পিছু হটে মক্কার বাহিনীর সারির পেছনে চলে যান। এরপর মক্কার বাহিনীর পতাকাবাহক তালহা ইবনে আবি তালহা আল-‘আবদারি মুসলিম বাহিনীর প্রতি দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানান। তার আহ্বানে সাহাবি যুবাইর ইবনুল আওয়াম সাড়া দিয়ে এগিয়ে যান এবং তাকে হত্যা করেন।
পতাকা বহনের দায়িত্ব তাদের পরিবারে থাকায়, তালহার ভাই উসমান ইবনে আবি তালহা পতাকা তুলে নেন। কিন্তু মুহাম্মাদ (সা.)-এর চাচা হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব তাকে হত্যা করেন। একে একে তালহার পরিবারের সদস্যরা এই দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে আসেন, কিন্তু তারা সবাই একের পর এক নিহত হন।
উহুদের যুদ্ধে দ্বন্দ্বযুদ্ধের পর শুরু হয় দুই বাহিনীর মূল লড়াই। কুরাইশ নারীরা দফ বাজিয়ে তাদের সেনাদের উজ্জীবিত করছিল। মুসলিম বাহিনী মক্কার সৈন্যদের সারি ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়, ফলে কুরাইশ বাহিনীর মনোবল কমে যায়। খালিদ বিন ওয়ালিদ মুসলিম বাহিনীর বাম পার্শ্বে আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু জাবালে রুমাতের ওপর অবস্থানরত মুসলিম তীরন্দাজদের কারণে তিনি প্রথম দিকে সফল হতে পারেননি। এতে মুসলিমরা যুদ্ধক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থান লাভ করে এবং বিজয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যায়।
তবে, মুসলিম তীরন্দাজদের মধ্যে কিছুজন নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর নির্দেশ অমান্য করে পাহাড় থেকে নেমে মূল বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন, ফলে তাদের বাম দিকের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে কুরাইশ বাহিনী আবার আক্রমণ চালায়, এবং মুসলিম বাহিনী বিশৃঙ্খলার মুখে পড়ে ।
উহুদের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর প্রথমে জয়ের সম্ভাবনা থাকলেও একটি ভুল পদক্ষেপের কারণে পরিস্থিতি বদলে যায়। কিছু মুসলিম তীরন্দাজ তাদের অবস্থান ছেড়ে দিলে, মক্কার অভিজ্ঞ যোদ্ধা খালিদ বিন ওয়ালিদ সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে মুসলিম বাহিনীর পেছন থেকে আক্রমণ করেন। এ সময় অবশিষ্ট তীরন্দাজরা আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হননি, ফলে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক সাহাবি শহীদ হন।
এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে, মুহাম্মাদ (সা.) আহত হন এবং তাঁর একটি দাঁত ভেঙে যায়। পাশাপাশি, একটি গুজবও ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি শহীদ হয়েছেন। এতে মুসলিম বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়, তবে কিছু সাহাবির প্রতিরোধের ফলে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে।
তীব্র সম্মুখযুদ্ধের পর অধিকাংশ মুসলিম উহুদ পর্বতের ঢালে জমায়েত হতে সক্ষম হয়। মুহাম্মাদ (সা.) পর্বতের শীর্ষে আশ্রয় নেন। মক্কার সেনারা পর্বতের দিকে অগ্রসর হতে চাইলেও উমর ইবনুল খাত্তাব ও মুসলিমদের একটি দলের কঠোর প্রতিরোধের কারণে তারা বেশি এগোতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধের তীব্রতা কমে যায় এবং দুই পক্ষের মধ্যে একটি অস্থায়ী স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিমদের সুরক্ষার জন্য এই মুহূর্তটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যেহেতু তারা পর্বতের ঢালে regroup হতে পেরেছিল
যুদ্ধের শেষে, হিন্দ এবং তার সঙ্গীরা মুসলিম সৈনিকদের মৃতদেহ লুণ্ঠন করতে শুরু করে। তারা নিহত মুসলিমদের কান, নাক কেটে নিয়ে তাদের পায়ের গয়না হিসেবে পরিধান করছিল। হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব এই যুদ্ধে ইথিওপীয় দাস ওয়াহশি ইবনে হারবের বর্শার আঘাতে নিহত হন। ওয়াহশি হামজাকে হত্যা করার জন্য একটি প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন যে, তাকে হত্যা করলে তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হবে। হামজার কলিজা চিবিয়ে খাওয়া হয়, যা যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা এবং প্রতিহিংসার চিত্র তুলে ধরে।
যুদ্ধ শেষে, মুসলিমরা উহুদ পর্বতের দিকে আশ্রয় নেয় এবং আবু সুফিয়ানের সাথে উমরের কথোপকথন হয়। আবু সুফিয়ান এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে বদরের প্রতিশোধ নেয়ার কথা উল্লেখ করেন, যার উত্তরে উমর বলেন যে, নিহত মুসলিমরা জান্নাতে এবং কাফিররা জাহান্নামে গেছে। পরে, মক্কার বাহিনী মক্কার দিকে ফিরে যায়, এবং মুসলিমরা নিহত সৈনিকদের মরদেহ যুদ্ধের ময়দানে দাফন করে।
ফলাফল
প্রথমে মুসলিম বাহিনী একটি সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল এবং তারা কুরাইশ বাহিনীর উপর কিছুটা আধিপত্য অর্জন করে। তবে যুদ্ধের এক পর্যায়ে, কুরাইশদের আক্রমণ এবং মুসলিম তীরন্দাজদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ কুরাইশদের হাতে চলে যায়। মুসলিম বাহিনী বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যায় এবং তারা পর্বতে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়।
কুরাইশ বাহিনী এরপর আর অগ্রসর হয়নি, যদিও তাদের কাছে বিজয়ের সুযোগ ছিল। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ীদের রীতি অনুযায়ী তিন দিন অবস্থান নেয়ার বদলে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলস্বরূপ, শেষপর্যায়ে মুসলিমদের তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষয়ক্ষতি ঘটে, তবে কুরাইশদের সুবিধাজনক অবস্থানের সত্ত্বেও যুদ্ধের ফলাফল অমীমাংসিত রয়ে যায়। এই যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয় এবং এর ফলে মুসলিমদের মধ্যে এক নতুন পর্যায়ের সূচনা হয়।
যুদ্ধবিদ্যায় উহুদের যুদ্ধ
এই যুদ্ধে পারস্য ও সিরিয়া বিজয়ের পূর্বে আরব যুদ্ধকৌশলের কিছু দিক স্পষ্ট হয়। আরবরা মূলত ঝটিকা আক্রমণ করত এমনটা ধারণা করা হলেও এক্ষেত্রে তা দেখা দেখা যায় না। মক্কার বাহিনী এখানে অশ্বারোহীদের পূর্ণ ব্যবহার করেছে।
মুহাম্মাদ সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। উহুদকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়া ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। মুসলিমদের ইচ্ছানুযায়ী তিনি খোলা ময়দানে যুদ্ধের সিদ্ধান নিলেও মক্কা বাহিনীর অধিক চলাচল সক্ষমতার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। খোলা ময়দানে লড়াইয়ের ফলে মুসলিম পদাতিকদের পার্শ্বগুলি আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই তিনি বাহিনীর পেছনের দিকে উহুদ পর্বতকে রেখে লড়াই করেন। এর ফলে পেছনের দিক থেকে কোনো আক্রমণ আসেনি। তাছাড়া সামনের অংশ প্রায়৮০০ থেকে ৯০০ গজ (৭৩০ থেকে ৮২০ মি) ছিল। একটি পার্শ্বভাগকে পর্বতের পাশে এবং অন্য পার্শ্বভাগকে পর্বতের গিরিপথের দিকে মোতায়েন করা হয়। তাই সামরিক দিক থেকে উভয় অংশ মক্কার অশ্বারোহীদের থেকে সুরক্ষিত ছিল। যে পথে আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সেদিকে তীরন্দাজদের স্থাপন করা হয়। অশ্বারোহী প্রধান বাহিনীর বিরুদ্ধে পদাতিক প্রধান বাহিনীর কীভাবে লড়াই করা উচিত এই যুদ্ধে তার নমুনা দেখতে পাওয়া যায়।
এই যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদ একজন দক্ষ সেনাপতি হিসেবে নিজের সামর্থ্য প্রদর্শন করেছেন। মুসলিম তীরন্দাজদের ভুল পদক্ষেপ নজরে পড়ার পর তিনি সুযোগ গ্রহণ করেন। ফলে মুসলিমরা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হন। পরবর্তীতে পারস্য ও সিরিয়া বিজয়ের সময় খালিদ সবচেয়ে সফল মুসলিম সেনাপতি হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।
বিভিন্ন মাধ্যমে উপস্থাপন
১৯৭৬ সালে নির্মিত মুস্তফা আক্কাদের চলচ্চিত্র দ্য মেসেজ-এ উহুদের যুদ্ধকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যেখানে ইসলামের প্রথম যুগের ঘটনাবলী তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও, ২০০৪ সালের এনিমেটেড চলচ্চিত্র মুহাম্মদ: দ্য লাস্ট প্রফেট-এও এই যুদ্ধের চিত্রায়ণ করা হয়েছে।
এছাড়াও, ২০১২ সালে প্রচারিত টিভি ধারাবাহিক উমরে-তে উহুদের যুদ্ধের কিছু দৃশ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে,