মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামের সর্বশেষ নবী এবং রাসূল হিসেবে পরিচিত, যিনি ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। ইসলাম ধর্মমতে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য চূড়ান্ত বার্তা নিয়ে আসেন। তাঁর পূর্ণ নাম হলো হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (ﷺ), এবং তিনি ছিলেন একজন ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতা, যিনি ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেন।
মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী, মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত শেষ নবী, এবং তিনি পূর্ববর্তী নবী ইব্রাহিম, মুসা, ঈসা (আ.)-এর শিক্ষাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে এসেছিলেন। তাঁর প্রধান কাজ ছিল আল্লাহর একত্ববাদ (তাওহীদ) প্রচার করা এবং মানবজাতিকে সত্যপথে পরিচালিত করা। মুসলমানেরা কুরআন এবং তাঁর জীবনাদর্শ (সুন্নাহ) অনুসরণ করে তাদের জীবন পরিচালনা করে, যা ইসলামের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবন এবং কর্ম মুসলমানদের জন্য একটি সম্পূর্ণ আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তাঁর জীবনের প্রতিটি দিক ইসলামের শিক্ষা ও অনুশীলনে গভীর প্রভাব রেখেছে।
মহানবি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম[১][২] | |
---|---|
مُحَمَّد | |
মুহাম্মাদ, আল্লাহর রাসুল মদিনায় মসজিদে নববীর দরজায় খোদাই করা | |
অন্য নাম | রাসুলুল্লাহ (‘সৃষ্টিকর্তার বার্তাবাহক’)মুহাম্মাদের নাম ও উপাধি দেখুন |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
জন্ম | আনু. ৫৭০ খ্রি. (৫৩ হিজরিপূর্ব)[৩] মক্কা, হেজাজ, আরব |
মৃত্যু | ৮ জুন ৬৩২ খ্রি. (১১ হিজরি; বয়স ৬১–৬২) মদিনা, হেজাজ, আরব |
সমাধিস্থল | মসজিদে নববির, সবুজ গম্বুজের নিচের সমাধিক্ষেত্র, মদিনা, সৌদি আরব ২৪°২৮′০৩″ উত্তর ৩৯°৩৬′৪১″ পূর্ব |
দাম্পত্য সঙ্গী | মুহাম্মাদের স্ত্রীগণ দেখুন |
সন্তান | মুহাম্মাদের সন্তানগণ দেখুন |
পিতামাতা | আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব (পিতা)আমিনা বিনতে ওহাব (মাতা) |
যে জন্য পরিচিত | ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক |
অন্য নাম | রাসুলুল্লাহ (‘সৃষ্টিকর্তার বার্তাবাহক’)মুহাম্মাদের নাম ও উপাধি দেখুন |
আত্মীয় | আহল আল-বাইত (‘বাড়ির সদস্য’)মুহাম্মাদের বংশধারা দেখুন |
আরবি নাম | |
ব্যক্তিগত (ইসম) | মুহাম্মাদ مُحَمَّد |
পৈত্রিক (নাসাব) | ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে আবদ মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ٱبْن عَبْد ٱللَّٰه بْن عَبْد ٱلْمُطَّلِب بْن هَاشِم بْن عَبْد مَنَاف بْن قُصَيّ بْن كِلَاب |
ডাকনাম (কুনিয়া) | আবু আল-কাসিম أَبُو ٱلْقَاسِم |
উপাধি (লাক্বাব) | খতমে নবুয়ত (‘সর্বশেষ প্রেরিত নবী’) خَاتَم ٱلنَّبِيِّين |
মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনুমানিক ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব তাঁর জন্মের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন, এবং ছয় বছর বয়সে তাঁর মাতা আমিনা বিনতে ওহাবও মৃত্যুবরণ করেন, ফলে তিনি এতিম হয়ে যান। এতিম মুহাম্মাদ (সা.) প্রথমে তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিব এবং পরে তাঁর চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠেন।
মুহাম্মাদ (সা.) মাঝে মাঝে মক্কার নিকটবর্তী নূর পর্বতের হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। আনুমানিক ৬১০ খ্রিস্টাব্দে, হেরা গুহায় ধ্যান করার সময় ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.) তাঁর কাছে এসে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম ওহি বা বাণী পৌঁছে দেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪০ বছর। এর তিন বছর পর, ৬১৩ খ্রিস্টাব্দে, তিনি সর্বসমক্ষে এই বাণী প্রচার করা শুরু করেন। মুহাম্মাদ (সা.) ঘোষণা করেন, “আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়”, এবং সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ বা ইসলামই জীবনের একমাত্র সঠিক পথ।
প্রথমদিকে, মুহাম্মাদ (সা.)-এর অনুসারীর সংখ্যা কম ছিল এবং তিনি ও তাঁর অনুসারীরা মক্কার কুরাইশদের পক্ষ থেকে নির্যাতনের শিকার হন। ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে কিছু অনুসারী আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) হিজরত করেন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে, ক্রমবর্ধমান নিপীড়নের কারণে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। এই ঘটনা ইসলামি বর্ষপঞ্জির সূচনা করে। মদিনায়, মুহাম্মাদ (সা.) বিভিন্ন গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং “মদিনার সনদ” প্রতিষ্ঠা করেন।
৬২৯ খ্রিস্টাব্দে, মক্কার গোত্রগুলোর সাথে দীর্ঘ বিরোধের পর, মুহাম্মাদ (সা.) দশ হাজার মুসলিম সৈন্যের বাহিনী নিয়ে মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হন এবং প্রায় বিনা রক্তপাতেই মক্কা বিজয় করেন। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে বিদায় হজ থেকে ফিরে কিছুদিন পর তিনি অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর সময়ে আরব উপদ্বীপের অধিকাংশ অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনের শে
ষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত বাণীগুলো কুরআনের আয়াত হিসেবে সংরক্ষিত হয়, যা মুসলিমদের নিকট আল্লাহর অবিকৃত বাণী হিসেবে স্বীকৃত। কুরআনের পাশাপাশি তাঁর জীবনাদর্শ ও সুন্নাহ, যা হাদিস ও সীরাহ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে, ইসলামি আইনের প্রধান উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়।
নাম ও উপাধি
মূল নিবন্ধ: মুহাম্মাদের নাম ও উপাধি |
মুসলিম সমাজে মুহাম্মাদকে অসংখ্য নাম ও উপাধি দেওয়া হয়েছে।[১৮] এই নামগুলোকে কুরআনে প্রদত্ত নাম, হাদিসে বর্ণিত নাম, পবিত্র গ্রন্থে বর্ণিত নাম এবং আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের (আসমাউল হুসনা) সাথে মিল আছে এমন নাম – এইভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। উসমানীয় পণ্ডিত মুস্তাকিমজাদে সুলাইমান সাদেদ্দিন (১৭১৯-১৭৮৮) তার “মিরাতুস সাফা ফি নুহবেতি এসমাইল মোস্তফা” গ্রন্থে মুহাম্মাদ এর ৯৯টি নাম ব্যাখ্যা করেছেন।[১৯][২০]
“”তার পুরো নাম হলো “আবুল কাসিম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে আব্দ মানাফ আল কুরাইশি” (“আরবি: “محمد بن عبد الله بن عبد المطلب بن هاشم بن عبد مناف القرشي”) অথবা সংক্ষেপে “আবুল কাসিম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুত্তালিব আল হাশিমি”। এই নামটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় “কুরাইশ গোত্রের আব্দুল মানাফের পুত্র হাশিম, হাশিমের পুত্র আব্দুল মুত্তালিব, আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আব্দুল্লাহ এবং আব্দুল্লাহর পুত্র ও কাসিমের পিতা মুহাম্মাদ”।[২১] “এছাড়াও বলা হয়ে থাকে, সমাজে তিনি “আল-আমিন” (বিশ্বস্ত ব্যক্তি, সত্যবাদী ব্যক্তি) উপাধি লাভ করেছিলেন এবং ‘মুহাম্মাদুল আমিন’ নামেও পরিচিত ছিলেন।”[২১]
মুহাম্মাদ নামটি আরবি ভাষার “হামদ” শব্দ থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ “প্রশংসা”।[২২]. “মুহাম্মাদ” অর্থ “প্রশংসিত”, “যিনি প্রশংসা পান”, “যিনি প্রশংসার যোগ্য”।[২১] “মুসলিমরা তাকে “মুস্তাফা”, “মাহমুদ” এবং “আহমদ” নামেও ডেকে থাকেন। “মুস্তাফা” অর্থ “নির্বাচিত” এবং “আহমদ” অর্থ “অধিক প্রশংসিত”। তার কুনিয়া (পিতৃত্বসূচক নাম) “আবু’ল-কাসিম”, যার অর্থ “কাসিমের পিতা”। আরব সমাজে কুনিয়া প্রথম পুত্রের নামের উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়।[২৩] মুহাম্মাদ নিজেকে “আবু’ল-বানাত” (কন্যাদের পিতা) হিসেবেও অভিহিত করেছিলেন কারণ তার সাত সন্তানের মধ্যে চারজনই ছিল কন্যা।
কুরআন অনুসারে, মুহাম্মাদ এর আগমন পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থ যেমন তাওরাত এবং ইঞ্জিল-এ ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে একটি হাদিসে মুহাম্মাদ বলেছেন, “কুরআনে আমার নাম মুহাম্মাদ, ইঞ্জিলে আহমদ এবং তাওরাতে আহয়েদ।”[২৪][২৫][২৬]
জার্মান প্রাচ্যবিদ (Orientalist) ভলকার পপ একটি মতবাদ প্রস্তাব করেছেন যে, “মুহাম্মাদ” এবং চতুর্থ খলিফার নাম “আলি” (যার অর্থ মহান) প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিবিশেষের নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি; বরং এগুলো উপাধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।[২৭]
কুরআন
মূল নিবন্ধ: কুরআনে মুহাম্মাদের নাম |
মুহাম্মাদ নামের বাংলা অর্থ “প্রশংসনীয়,” এবং এটি পবিত্র কুরআনে মোট চারবার উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে মুহাম্মাদ (সা.)-কে বিভিন্ন উপাধি দ্বারা সম্বোধন করা হয়েছে, যা তাঁর মহান ব্যক্তিত্ব এবং আল্লাহর বাণীবাহক হিসেবে তাঁর ভূমিকা নির্দেশ করে। কুরআনে উল্লেখিত মুহাম্মাদ (সা.)-এর উপাধিগুলো হলো:
- আহমাদ (প্রশংসিত) — [কুরআন ৬১:৬]
- নবী (নবী)
- রাসূল (বার্তাবাহক)
- আল্লাহর বান্দা (‘আবদ) — [কুরআন ৭২:১৯]
- ঘোষক (‘বশির’) — [কুরআন ২:১১৯]
- সাক্ষী (‘শহীদ’) — [কুরআন ৩৩:৪৫]
- সুসংবাদদাতা (‘মুবাশ্শীর’)
- সতর্ককারী (‘নাজির’) — [কুরআন ১১:২]
- স্মরণকারী (‘মুজাক্কির’) — [কুরআন ৮৮:২১]
- সৃষ্টিকর্তার বার্তাবাহক (‘দাঈ’) — [কুরআন ১২:১০৮]
- আলোকিত ব্যক্তিত্ব (‘নূর’) — [কুরআন ৫:১৫]
- আলো-প্রদানকারী বাতি (‘সিরাজ মুনির’) — [কুরআন ৩৩:৪৬]
এই উপাধিগুলো মুহাম্মাদ (সা.)-এর চরিত্র, দায়িত্ব এবং আল্লাহর সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ককে তুলে ধরে, যা মুসলিমদের জন্য নির্দেশনা এবং অনুপ্রেরণার উৎস।
বংশধারা
মূল নিবন্ধসমূহ: আদনানি আরব, কুরাইশ ও মুহাম্মাদের বংশধারা |
মুহাম্মাদের (সা.) বংশধারা নিয়ে সুপ্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, তিনি নবী ইসমাইল (আ.) এর বংশধর ছিলেন। তার বংশলতিকা আদনানি উপজাতি পর্যন্ত বিস্তৃত এবং কুরাইশ বংশের হাশিমী শাখা থেকে উদ্ভূত বলে ধারণা করা হয়। তার বংশক্রম সাধারণত নিম্নরূপ বর্ণিত হয়:
- মুহাম্মাদ (সা.)
- আবদুল্লাহ
- আব্দুল মুত্তালিব (শায়বা)
- হাশিম
- আবদ মানাফ (মুগিরা)
- কুসাই
- কিলাব
- মুররাহ
- কা’ব
- লুয়াই
- গালিব
- ফিহর
- মালিক
- নাদর (কুরাইশ)
- কিনানাহ (কিনানা উপজাতি)
- হুজাইমা
- মুদরিকা (আমির)
- ইলিয়াস
- মুদার
- নিজার
- মা’আদ
- আদনান
এই বংশতালিকা ইসলামী ঐতিহ্যগতভাবে স্বীকৃত এবং বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখিত। তবে, রেফারেন্সগুলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ থেকে উঠে এসেছে, বিশেষ করে:
- ইবনে ইসহাকের সীরাত: মুহাম্মাদের প্রাথমিক জীবনী সংকলন যা তার বংশ নিয়ে বিশদ আলোচনা করে।
- ইবনে হিশামের “আল-সীরাহ”: মুহাম্মাদের জীবন নিয়ে ইবনে ইসহাকের কাজের পরিমার্জিত সংস্করণ।
- আল-তাবারি: প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ যিনি ইসলামের ইতিহাস ও বংশতালিকা সংক্রান্ত ব্যাপক তথ্য সংকলন করেছেন।
রেফারেন্স নম্বর ৮২-৮৭ এর প্রাসঙ্গিক উৎসগুলোর মধ্যে এই গ্রন্থসমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
অন্যদিকে, কিছু হাদিস অনুসারে মুহাম্মাদ নিজের বংশধারা ইব্রাহিম এর সাথে সংযুক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন,
আল্লাহ ইবরাহীম এর সন্তানাদির মধ্য থেকে ইসমাঈল কে, “ইসমাঈল এর সন্তানাদির মধ্যে থেকে কিনানাহকে মনোনীত কড়েন। কিনানাহর বংশধারার মধ্য থেকে কুরাইশকে,”কুরাইশ থেকে বনু হাশিমকে এবং বনু হাশিম থেকে আমাকে মনোনীত করেন”। ” |
— সহিহ মুসলিম, আত-তিরমিজি, “[৮৮][৮৯] |
ঐতিহ্য অনুসারে, মক্কা বিজয়ের পর যখন কাবাঘর থেকে মূর্তিগুলো সরিয়ে ফেলা হচ্ছিল, তখন কাবার ভেতর থেকে হাতে ভবিষ্যদ্বাণীর তীর ধারণকারী ইব্রাহিম ও তার পুত্র ইসমাইল এর মূর্তি উদ্ধার করা হয়। মুহাম্মাদ তখন বলেছিলেন যে তারা কখনোই এমন কাজ করেননি এবং মূর্তিপূজার উপকরণ হিসেবে তাদের ব্যবহারের জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। অন্য একটি হাদিস অনুসারে, মুহাম্মাদ তার নাতি হাসান ও হুসাইন এর জন্য যে দোয়া করেছিলেন, ইব্রাহিম পূর্বে তার নিজ পুত্র ইসমাইল ও ইসহাক এর জন্য একই দোয়া করেছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন।[৯০]
কিছু সংশোধনবাদী গবেষকের মতে, “কুরাইশ” নামটি নবী মুহাম্মাদ এর বংশধরদের গোত্রের নাম নয়, বরং এটি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারস্যে হাখমানেশি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা পারস্য সম্রাট কুরুশের নাম। সম্রাট কুরুশ ব্যাবিলনীয় বন্দিদশা থেকে ইহুদিদের মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ইহুদিদের মধ্যে তিনি অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব।[৯১] ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে, মুহাম্মাদ এর বংশোদ্ভূত কুরাইশ গোত্রটি প্রাচীন আরব সভ্যতা নবতাঈদের একটি শাখা ছিল। নবতাঈদের আদি বাসস্থান ছিল আরব উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এবং তারা তাদের নিজস্ব লিপি ও ভাষার অধিকারী ছিল। নবতাঈদের বংশোদ্ভূতি নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান।[৯২] কিছু মতামত অনুসারে, তারা আদি আরব বংশোদ্ভূত, যদিও পরবর্তীতে পারস্যদের সাথে মিশে তাদের বংশধারা ও ভাষায় পরিবর্তন আসে।[৯২]
জন্ম তারিখ
আরও দেখুন: হস্তিবর্ষ |
প্রচলিত ধারণা অনুসারে, ইসলামের ইতিহাসে “ফিলবর্ষ” (হস্তিবর্ষ) নামে পরিচিত সময়ে হযরত মুহাম্মাদ মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন।[৯৩] ঐতিহ্য অনুসারে, এই বছরটি হলো আবিসিনিয়ার আকসুম রাজ্যের অধীনস্থ ইয়েমেনের রাজা আবরাহা কাবাঘর আক্রমণের জন্য বিশাল হাতিবাহিনী নিয়ে ব্যর্থ অভিযান চালানোর বছর।[৯৪][৯৫] এই নির্দিষ্ট তারিখটি স্পষ্টভাবে জানা যায় না এবং পূর্ববর্তী সময়ের হিসাব অনুসারে বিভিন্ন উৎসে ভিন্ন ভিন্ন তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। পাকিস্তানি ইসলামী পণ্ডিত মোহাম্মদ হামিদুল্লাহর মতে, তারিখটি ১৭ জুন ৫৬৯;[৯৩] কিছু উৎসে ৫৭০ সাল উল্লেখ করা হয়েছে;[৯৬][৯৭] মিশরীয় পণ্ডিত মাহমুদ পাশা আল-ফালাকীর মতে, তারিখটি ২০ এপ্রিল ৫৭১।[৯৮] ব্রিটিশ লেখক শেরার্ড বোমন্ট বার্নাবী আল-ফালাকীর হিসাবের কিছু ত্রুটি উদঘাটন করেছেন।[৯৯]
ইসলামী উৎসগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী মুহাম্মাদ ৫৭১ সালে, ফিল ঘটনা এর বছর, ১২ই রবিউল আউয়াল (২০শে এপ্রিল) সোমবার রাতে জন্মগ্রহণ করেন।[১০০] এই তারিখটি ফিল ঘটনা এর ৫২ দিন পরে।[৯৮][১০১] সীরাত ও ইসলামী ইতিহাসের লেখকরা এই বিষয়ে একমত যে, নবী মুহাম্মাদ রবিউল আউয়াল মাসের একটি সোমবার ভোরবেলা, সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ আগে জন্মগ্রহণ করেন। তবে, মাসের কত তারিখে তিনি জন্মগ্রহণ করেন সে বিষয়ে তাদের মতপার্থক্য রয়েছে।[৯৮] এই মতভেদের কারণ হিসেবে মৌখিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবে রিওয়ায়েতের বৈচিত্র্য, চন্দ্র ক্যালেন্ডার ও সৌর ক্যালেন্ডারের পার্থক্য[১০২][১০৩] এবং আরবদের “নাসি” প্রথা (বছরকে ১২ মাসের পরিবর্তে ১০ মাস ধার্য করা) উল্লেখ করা হয়।[১০১]
লরেন্স কনরাড মৌখিক যুগের পরের প্রাথমিক যুগে লেখা জীবনী গ্রন্থগুলো পর্যালোচনা করেছেন এবং এই গ্রন্থগুলোতে মুহাম্মাদের জন্ম তারিখের ক্ষেত্রে ৮৫ বছরের সময়কালের ব্যবধান দেখতে পেয়েছেন। কনরাড এটিকে “গল্পের প্রবাহিততা (বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়া) এখনও চলমান” হিসাবে বর্ণনা করেছেন।[১০৪][১০৫]
প্রাক-ইসলামি আরব
মূল নিবন্ধসমূহ: প্রাক-ইসলামি আরব ও প্রাক্-ইসলামি আরবে ধর্মবিশ্বাস |
সাধারণ ভৌগোলিক অবস্থা
ইসলাম পূর্ববর্তী আরব উপদ্বীপে, কঠিন পরিবেশগত পরিস্থিতি এবং জীবনধারার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে মরুভূমির পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্য, মানুষের একসাথে বসবাস করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। এর ফলে, যে গোষ্ঠীগুলোর উত্থান হয়েছিল সেগুলো রক্তের সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছিল।[১০৬] স্থানীয় আরবরা, যাযাবর এবং স্থায়ী উভয় জীবনযাপনই করত।[১০৭] পানি এবং চারণভূমি খুঁজে বের করার জন্য যাযাবররা একসাথে একটি স্থান থেকে অন্য স্থানে যেত, অন্যদিকে স্থায়ী জীবনযাপনকারীরা বাণিজ্য এবং কৃষিকাজের সাথে জড়িত ছিল। কাফেলা বা ওয়াহাতে আক্রমণ করাও যাযাবরদের জীবনের একটি অংশ ছিল এবং তারা এটিকে অপরাধ বলে মনে করত না।[১০৮][১০৯][১১০]
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ থেকে, মসলা বাণিজ্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধ বেশ কিছু উন্নত রাজ্য দক্ষিণ আরবে অস্তিত্ব লাভ করেছিল। প্রাথমিকভাবে, বাণিজ্য পথগুলো উত্তর-পশ্চিম উপকূল দিয়ে চলেছিল, কিন্তু ৭ম শতাব্দীর পর থেকে, ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যবসায়ীরা লোহিত সাগরের উপর দিয়ে সমুদ্রপথ ব্যবহার করতে পছন্দ করায়, এই অঞ্চলের বাণিজ্য হ্রাস পেয়েছিল এবং অনেক অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ স্থান অবনতির দিকে ধাবিত হয়েছিল।[১১১] ধান্য এবং জলপাই তেলের মতো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের পাশাপাশি উল এবং চামড়ার বাণিজ্য, আরও স্থানীয় বাণিজ্যিক কার্যকলাপের উপর নির্ভরশীল মক্কা এবং মদিনা (যা তখন “ইয়াসরিব” নামে পরিচিত ছিল) এর মতো কয়েকটি শহর টিকে ছিল। আরব উপদ্বীপের মরুভূমির অঞ্চলগুলো ছিল অত্যন্ত দরিদ্র। বেদুঈন গোষ্ঠীগুলো যাযাবর জীবনধারা গ্রহণ করেছিল এবং সীমিত সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিযোগিতাপূর্ণভাবে সমাজকে রূপ দিয়েছিল; প্রধানত বংশ বা গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য স্বীকৃত হয়েছিল।[১১১]
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে, বাইজেন্টাইন এবং সাসানি সাম্রাজ্য ছিল দুটি প্রধান শক্তি যারা মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণ করত। শতাব্দী দীর্ঘ পারস্য-রোমান যুদ্ধ এই অঞ্চলকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। পারস্যদের লাখমিদ এবং রোমানদের গাসানীদের মতো সামন্ত রাষ্ট্র ছিল এই অঞ্চলে। আরব উপদ্বীপের ভূগোল অত্যন্ত শুষ্ক এবং আগ্নেয়মৃত্তিকার কারণে, মরুদ্যান এবং পানির উৎস ছাড়া অন্যত্র কৃষি করা কঠিন ছিল। মরুভূমির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিন্দু-আকৃতির গ্রাম এবং শহরগুলো এই অঞ্চলের সাধারণ চিত্র তুলে ধরে। মক্কা এবং মদিনা (ইয়াসরিব) ছিল এই শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মদিনা ছিল একটি ক্রমবর্ধমান বৃহৎ কৃষিক্ষেত্র, যখন মক্কা ছিল অনেক গোষ্ঠী দ্বারা বেষ্টিত একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক কেন্দ্র এবং হজের কারণে একটি তীর্থস্থান।[১১২]” মুহাম্মাদের জীবনের প্রথম দিকে, তার অন্তর্গত কুরাইশ গোত্র পশ্চিম আরবে একটি প্রভাবশালী শক্তি হয়ে ওঠে।[১১৩][১১৪] “কুরাইশরা পশ্চিম আরবের অনেক গোষ্ঠীর সদস্যদের কাবা ঘরের সাথে যুক্ত করে এবং এই মক্কার তীর্থক্ষেত্রের মর্যাদা বৃদ্ধি করে একটি সাংস্কৃতিক ঐক্য স্থাপন করে।[১১৪]
জাহেলি যুগ
মূল নিবন্ধ: আইয়ামে জাহেলিয়া |
“ইসলামী সাহিত্যে, আরব সমাজের ইসলাম পূর্ব যুগকে “আইয়ামে জাহেলিয়া” বা মূর্খতার যুগ বলা হয়।[১১৫]” ইসলামী যুগে উদ্ভূত এই শব্দটি কুরআন ও হাদিসে আরবদের ইসলাম পূর্ব বিশ্বাস, মনোভাব ও আচরণ, “সামাজিক জীবন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাধারণভাবে ব্যক্তি ও সমাজের পাপ ও বিদ্রোহকে ইসলামী যুগ থেকে আলাদা করতে বা গ্রহনযোগ্য করতে ব্যবহৃত হয়।[১১৫]” জাহেলিয়া যুগের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়: ব্যভিচার, পরকীয়া, চুরি, মূর্তিপূজা, অন্যায়, সহিংসতা, গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্তহীন রক্তক্ষয়ী বিবাদ, ডাকাতি, দাসপ্রথা, বিশেষ করে নারীর দাসত্ব এবং পণ্যের মতো ক্রয়-বিক্রয়, নারীর প্রতি এমন অবমাননা যে জাহেলিয়া সমাজের মানুষদের কাছে মেয়ে সন্তানকে লজ্জা বলে মনে করা হত এবং কন্যাসন্তানকে জীবন্ত অবস্থাতেই কবর দেয়ার নিদর্শনও ছিল।[১১৬]
ইসলামী ইতিহাসগ্রন্থ অনুসারে, জাহেলিয়াতের যুগের কবিতায় নারীর উপলব্ধি সমাজজীবনে প্রতিফলিত হয়নি। নারীকে নিম্ন শ্রেণীর মানুষ হিসেবে দেখা হতো। সীমাহীন বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। পতিতাবৃত্তি একটি সাধারণ পেশায় পরিণত হয়েছিল এবং দাস মালিকরা তাদের ক্রীতদাসদের এটি করতে বাধ্য করত। নারীদের পিতা বা স্বামীর উত্তরাধিকারের অংশ পাওয়ার অধিকার ছিল না। সন্তানরা চাইলে বাবার মৃত্যুর পর তাদের সৎ মাকে বিয়ে করতে পারত। বিবাহবিচ্ছেদের অধিকারও শুধুমাত্র পুরুষদের ছিল এবং তা সীমাহীন ছিল। যখন সম্ভ্রান্তদের কন্যা সন্তানের জন্ম হম, তখন তারা এটিকে লজ্জার বিষয় হিসেবে দেখতে এবং তাদের হত্যা করতেও পিছপা হতোনা।[১১৬] ইসলামী সমাজের স্মৃতিতে, জাহেলিয়া যুগে জীবিত কন্যা শিশুকে মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে।[১১৭] কুরআনের সূরা তাকভীর এর ৮ম ও ৯ম আয়াতে কন্যা শিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে এই ঘটনার সমালোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে,
যখন জীবন্ত পুঁতে-ফেলা কন্যা-শিশুকে জিজ্ঞেস করা হবে, কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে? |
— সূরা তাকভীর, আয়াত ৮-৯ |
কন্যা শিশুকে জীবন্ত কবর দেয়ার প্রথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল না, তবে মাঝে মাঝে এটি করা হত। কিছু গোত্রের মধ্যে এই ঘটনা বেশি দেখা গেলেও, অন্যদের মধ্যে এটি খুবই বিরল ছিল। এছাড়াও, শহরের তুলনায় মরুভূমি ও গ্রামাঞ্চলে এটি বেশি দেখা যেত। তবে, মুহাম্মাদের গোত্র কুরাইশদের মধ্যে এই প্রথা বিদ্যমান ছিল বলে মনে করা হয়, তবে তা ব্যাপক ছিল না।[১১৭] আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক যে, কোরবানি দেওয়া বা অন্য কারণে শিশু হত্যার ক্ষেত্রে আরবরা অন্য জাতিদের তুলনায় খুব বেশি আলাদা ছিল না।[১১৮]
উপাসনা ও ধর্মীয় গোষ্ঠী
মূল নিবন্ধসমূহ: পৌত্তলিকতাবাদ, মূর্তিপূজা ও প্রাক-ইসলামি আরবে ধর্মবিশ্বাস |
ইসলাম পূর্ব আরবের প্রতিটি গোত্র তাদের নিজস্ব দেবতা ও দেবীকে রক্ষাকর্তা হিসেবে মনে করত। এই দেবতা ও দেবীদের আত্মা পবিত্র বৃক্ষ, পাথর, পানির উৎস এবং কূপের সাথে সম্পর্কিত ছিল। আরব পৌরাণিক কাহিনী ও সংস্কৃতিতে, প্রতীকী দেবতা ও দেবীর কারণে মূর্তিগুলোকে পবিত্র মনে করা হত এবং পূজার প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হত।[১১৯] ইসলাম পূর্ব আরব উপদ্বীপে অসংখ্য পবিত্র স্থান এবং সেখানে নির্মিত ঘনক্ষেত্রাকৃতি দেবালয় ছিল। জানা যায়, এই পবিত্র স্থান ও দেবালয়গুলো আরবরা হারাম (নিষিদ্ধ) মাসগুলোতে পরিদর্শন করত এবং এই মন্দিরগুলিতে বিভিন্ন উপাসনা ও আচার-অনুষ্ঠান পালন করত।[১২০]
মক্কার কাবা ৩৬০টি মূর্তির আবাসস্থল ছিল, যা বিভিন্ন গোত্রের রক্ষাকর্তা দেবতা হিসেবে বিবেচিত হত।[১১৯] মানাত, লাত ও উজ্জা নামক তিন দেবীকে প্রধান দেবতা ইলাহ এর কন্যা বলে মনে করা হত। এই সময়ের অধিকাংশ আরব বাসিন্দা বহুঈশ্বরবাদ ও পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী ছিল।[১২১] কিছু আরব গোত্র আল্লাহ’র অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিল, তবে পরকাল ও কিয়ামতের ধারণা তাদের মধ্যে ছিল না।[১২১] বেশিরভাগ মূর্তিপূজক মূর্তিগুলোকে ঈশ্বর হিসেবে গ্রহন করত না, বরং ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর জন্য এক ধরণের মাধ্যম হিসেবে দেখত।[১২১] যুদ্ধ নিষিদ্ধ তীর্থের মাসগুলোতে (হারাম মাস) আরব গোত্রগুলো উৎসব ও মেলায় অংশগ্রহণ করত।[১২২] এই উৎসবগুলোতে তারা নিজ নিজ গোত্রের মূর্তির প্রতি প্রার্থনা, সিজদা ও সম্মান প্রদর্শন করত, মূর্তির নামে কুরবানি দিত এবং দান করত। এরপর প্রতিটি গোত্র কাবা তাওয়াফ করত। এই তাওয়াফ সাধারণত উলঙ্গ অবস্থায় করা হত।[১২৩] এই পরিদর্শনগুলোতে তারা দেবতাদের বিভিন্ন উপহার দান করত, সুগন্ধি ব্যবহার করত এবং এমনকি এই পরিদর্শনগুলোর পূর্বে রোজা (উপস) রাখত।[১২৩] এই সময়ে বদনজর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাবিজ ও কবজ ব্যবহার করাও ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।[১২৩]
এই সকল বহুঈশ্বরবাদী ও পৌত্তলিক রীতিনীতির পাশাপাশি খ্রিস্টান, ইহুদি এবং মাজুসদের মতো একঈশ্বরবাদী বিশ্বাসে বিশ্বাসী বিভিন্ন সম্প্রদায়ও আরব উপদ্বীপে বিদ্যমান ছিল।[১২৪] শক্তিশালী ইহুদি গোষ্ঠীগুলো দক্ষিণে ইয়েমেন এবং উত্তর-পশ্চিমে মদিনার মতো কৃষিভিত্তিক মরুদ্যান শহরগুলোতে বসতি স্থাপন করেছিল। খ্রিস্টানরাও ইয়েমেন এবং পূর্ব আরবে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে শুরু করেছিল। যদিও একঈশ্বরবাদী বিশ্বাস বেদুঈন আরবদের ঐতিহ্যবাহী বহুঈশ্বরবাদী বিশ্বাসের উপর প্রভাব ফেলেছিল, তবুও বহুঈশ্বরবাদ তখনো খুবই শক্তিশালী ছিল।[১১১] মুহাম্মাদের সময়ে, আরব উপদ্বীপ সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে উত্তাল ও অস্থিতিশীল ছিল।[১১১]
আরব উপদ্বীপের স্থানীয় আরবদের মধ্যে হানিফরা ছিল একঈশ্বরবাদী বিশ্বাসীদের একটি সম্প্রদায়।[১২৫] তাদেরকে ভুলভাবে মাঝে মাঝে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সাথে শ্রেণীবদ্ধ করা হত।[১২৬] ইসলামী শিক্ষা অনুসারে, ইসলাম পূর্ব যুগে ইব্রাহিম কর্তৃক প্রচারিত ধর্মের অনুসারীদের হানিফ বলা হত।[১২৭] কুরআনের কিছু আয়াতে “হানিফ” শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে এবং হানিফ ধর্মকে মুশরিক ও পৌত্তলিকদের বহুঈশ্বরবাদী ধর্মের থেকে আলাদা ও তার বিপরীত এবং ইব্রাহিম এর ধর্ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা বাকারা এর ১৩৫নং আয়াতে বলা হয়েছে,
তারা বলে, ‘তোমরা ইহুদী বা নাসারা (খ্রিস্টান) হয়ে যাও তাহলে সঠিক পথ পাবে’। বল, ‘বরং একনিষ্ঠ হয়ে ইব্রাহিমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্গত ছিলেন না’। |
— সূরা বাকারা, আয়াত ১৩৫ |
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, মুহাম্মাদও একজন হানিফ ছিলেন এবং তিনি ইব্রাহিম এর পুত্র ইসমাইল এর বংশধর ছিলেন।[১২৮][১২৯][১৩০]
নবী আগমনের প্রত্যাশা
ধ্রুপদী ধর্মীয় বর্ণনা অনুসারে, ইসলাম পূর্ব যুগে, হানিফ ধর্মাবলম্বী আরব কবিরা, যাদের রহস্যময় ক্ষমতার অধিকারী বলেও মনে করা হত, তাদের কবিতায় একজন নবীর আসন্ন আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। যদিও কুরআনে ভবিষ্যদ্বাণী ও অনুরূপ অনুশীলনগুলোকে সমর্থন করা হয় না, তবুও ওসব সমাজে এই ধরণের বক্তব্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হত।[১৩১]
কুরআনের সূরা আস-সাফ এর ৬নং আয়াত অনুসারে, নবী ঈসা বনী ইসরাঈলকে সম্বোধন করে বলেছিলেন
“স্মরণ কর, “যখন মরিয়মের পুত্র ‘ঈসা বলেছিল, “‘হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর রসূল, আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি একজন রাসুলের সুসংবাদদাতা যিনি আমার পরে আসবেন, যার নাম আহমাদ।’ “অতঃপর সে [অর্থাৎ ‘ঈসা যাঁর সম্পর্কে সুসংবাদ দিয়ে ছিলেন সেই নবী] “যখন তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে আসল, তখন তারা বলল, ‘এটা তো স্পষ্ট যাদু”।’ |
— সূরা আস-সাফ, আয়াত ৬, [১৩২] |
মুহাম্মাদ এর নাম বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বিভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে বলে একটি ধারণা প্রচলিত। এর মধ্যে একটি হাদিসে বলা হয়েছে, “আমার নাম কুরআনে মুহাম্মাদ, ইঞ্জিলে আহমদ এবং তাওরাতে আহ্যদ।”[১৩৩] তবে, বর্তমান আধুনিক ইঞ্জিলগুলোতে এই নামগুলোর স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে, কিছু ইসলামী পণ্ডিত যোহন ইঞ্জিলের “পারাক্লিত” শব্দটিকে মুহাম্মাদ এর সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করেন।[১৩৪] খ্রিস্টধর্মে পারাক্লিত-কে “পবিত্র আত্মা” হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।[১৩৫] যোহন ইঞ্জিলের ১৪তম অধ্যায়ে, যিশু কর্তৃক পারাক্লিত (“সত্যের আত্মা”) সম্পর্কে বলা হয়েছে,
আমিও পিতাকে অনুরোধ করব, “আর তিনি তোমাদের সঙ্গে চিরকাল থাকার জন্য তোমাদের অন্য একজন সাহায্যকারী, সত্যের আত্মা, দেবেন। জগৎ তাঁকে গ্রহণ করতে পারে না, কারণ সে তাঁকে দেখে না, না জানে। তোমরা তাঁকে জান, “কারণ তিনি তোমাদের মধ্যে বাস করেন এবং তোমাদের মধ্যে থাকবে। |
— যোহন ইঞ্জিল, ১৪তম অধ্যায় : ১৬-১৭, [১৩৬][১৩৭] |
সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত উসমানীয় পর্যটক ইভলিয়া সেলেবি[১৩৮][১৩৯] তার সেয়াহতনামা গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে তিনি লেবাননের দক্ষিণে নাকুরা শহরের কাছে প্রেরিত পিতর এর সমাধিতে একটি ইঞ্জিলের পাণ্ডুলিপি খুঁজে পেয়েছেন।[১৪০] প্রেরিত পিতর ছিলেন যিশু এর একজন হাওয়ারী। ইভলিয়া সেলেবি দাবি করেছেন যে ওই পাণ্ডুলিপিতে মুহাম্মাদ এর আগমনের সুসংবাদ বর্ণিত ছিল। তিনি আরও দাবি করেছেন যে ওই পাণ্ডুলিপিটি স্বয়ং প্রেরিত পিতর লিখেছিলেন।[১৩৮][১৪১][১৪২] কিন্তু ইভলিয়া সেলেবি কর্তৃক উল্লেখিত ওই পাণ্ডুলিপিটি আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মক্কার জীবন
মূল নিবন্ধ: মক্কায় মুহাম্মাদ |
সারসংক্ষেপ
কিছু উৎস অনুসারে, মুহাম্মাদ ৫৭০ সালে[১৪৩][১৪৪][১৪৫] এবং কিছু উৎস অনুসারে ৫৭১ সালে[১৪৬] আরবের মক্কা শহরে জন্মগ্রহণ করেন।[১৪৩][১৪৪][১৪৭] জন্মের আগে তার বাবা আব্দুল্লাহ মারা যান এবং ৬ বছর বয়সে তার মা আমিনা মারা যাওয়ার পর তার চাচা আবু তালিব তাকে লালন-পালন করেন। শৈশবে তিনি চরবাহা (মেষপালন) করতেন এবং তারপর একজন ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করেন। প্রথমবারের মতো ২৫ বছর বয়সে তিনি মক্কার বিখ্যাত এবং সম্মানিত ব্যক্তিত্ব, ৪০ বছর বয়সী একজন ধনী বিধবা খাদিজাকে বিবাহ করেন।[১৪৮]
মুহাম্মাদ নিয়মিতভাবে কিছু রাত নূর পর্বতের হেরা গুহায় গিয়ে ধ্যান করতেন। ৩৫ বছর বয়সের পর তার এই অভ্যাস আরও ব্যাপক হয়ে ওঠে। ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, ৪০ বছর বয়সে[১৪৩][১৪৪] কুরআনের প্রথম আয়াত মুহাম্মাদের উপর অবতীর্ণ হয়[১৪৯] এবং তিনি জানান যে এগুলো আল্লাহর নিকট হতে জিবরাঈল ফেরেশতা কর্তৃক প্রেরিত। প্রথমে তিনি কেবল আপনজনদের ইসলামের প্রতি আহ্বান জানা এবং তিন বছর পর থেকে মানুষকে সামগ্রিকভাবে ইসলামে আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করেন।[১৫০] তিনি আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয় এই বার্তা প্রচার করেন এবং বলেন যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একমাত্র উপায় হলো আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ।[১৫১] তিনি নিজেকে আল্লাহর রাসুল ও নবী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং বলেন যে তিনি পূর্ববর্তী নবীদের বংশধর।[১৫২][১৫৩]
প্রথম দিকে মুহাম্মাদের অনুসারী সংখ্যা ছিল অল্প। তিনি মক্কার কিছু গোত্র এবং কিছু আত্মীয়ের বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এই সময়ে তার অনুসারীরা তীব্র নির্যাতনের শিকার হওয়ায় তিনি ৬১৫ সালে কিছু অনুসারীকে আবিসিনিয়ার আকসুম রাজ্যে পাঠান। ৬২২ সালে নিজের অনুসারীদের সাথে মদিনায় হিজরত করেন।
মদিনায় পৌঁছানোর পর মুহাম্মাদ মদিনার সনদ নামক সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে সেখানকার গোত্রগুলোকে একত্রিত করেন। মক্কার গোত্র এবং পৌত্তলিকদের সাথে আট বছর ধরে যুদ্ধ চলার পর তার অনুসারীর সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়ে যায়।[১৫৪] ৬৩০ সালের শুরুতে দশ হাজার সাহাবির এক বিশাল মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বে[১৫৫] মক্কা অবরোধের পর একটি চুক্তির মাধ্যমে রক্তপাতহীনভাবে মক্কার নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন।[১৫৫][১৫৬] তিনি শহরে প্রবেশ করে সকল মূর্তি ভেঙে ফেলেন এবং তারপর তার অনুসারীদের পূর্ব আরব-এ অবশিষ্ট সকল পৌত্তলিক মন্দির ধ্বংস করার জন্য পাঠান।[১৫৭][১৫৮][১৫৯] অল্প সময়ের মধ্যে অনেক সকল অভিযান পরিচালনন করে তিনি আরবের বেশিরভাগ অংশ জয় করেন। ৬৩২ সালে বিদায় হজ্জ পালন করেন এবং আরাফাত পর্বতে এক লক্ষেরও বেশি সমবেত মুসলিমের উপস্থিতিতে বিদায়ী ভাষণ প্রদান করার পর মদিনায় ফিরে আসেন। এর কয়েক মাস পর তিনি অসুস্থ হয়ে মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর সময় আরব উপদ্বীপের অধিকাংশ অধিবাসী ইসলাম গ্রহণ করে এবং তিনি আরব উপদ্বীপকে একটি এককরাষ্ট্রের অধীনে একত্রিত করেছিলেন।[১৬০][১৬১]
শৈশব ও কৈশোর
মুহাম্মাদ এর পিতা আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং মাতা কুরাইশ গোত্রের ওয়াহাব ইবনে আবদ মান্নাফ-এর কন্যা আমিনা। জন্মের প্রায় পাঁচ-ছয় মাস আগেই মুহাম্মাদ এর পিতা আবদুল্লাহ মারা যান। এরপর তার লালন-পালনের ভার দাদা আবদুল মুত্তালিব গ্রহণ করেন। আবদুল মুত্তালিব তার নাম “মুহাম্মাদ” রাখেন। তার মাতা আমিনা শিশু মুহাম্মাদকে পূর্ণাঙ্গভাবে স্তন্যদান করতে পারেননি। কিছু সময়ের জন্য মুহাম্মাদকে তার চাচা আবু লাহাব-এর দাসী সুওয়াইবা স্তন্যদান করেন।[১৬২] তৎকালীন আরবের রীতিনীতি অনুসারে, মক্কার নবজাতকদের মরুভূমি ও প্রকৃতির জীবনকে শিশুদের জন্য আরও স্বাস্থ্যকর মনে করে, কিছু সময়ের জন্য মরুভূমিতে একটি বেদুঈন পরিবারের সাথে থাকার জন্য পাঠানো হত এবং স্তন্যদাত্রী মহিলাদের দ্বারা স্তন্যদান ও লালনপালন করা হত।[১৬৩][১৬৪] বাবা না থাকায় এক অনাথের যত্ন নেওয়া লাভজনক হবে না ভেবে স্তন্যদানকারী মহিলারা মুহাম্মাদকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।[১৬৩] কিন্তু সেই সময়ে মক্কায় স্তন্য শিশু খুঁজতে আসা এবং কোন শিশু খুঁজে না পাওয়া হালিমা নামের বনু সা’দ গোত্রের এক মহিলা, অনিচ্ছা সত্ত্বেও, মুহাম্মাদকে গ্রহণ করতে রাজি হন।[৯৮][১০১][১৬৩][১৬৫][১৬৬] মুহাম্মাদ দুধমা হালিমা এবং তার স্বামী হারিস এর কাছে দুই বা তিন বছর বয়স পর্যন্ত থাকেন।[১৬৭] হালিমা মুহাম্মাদকে স্তন্যদান ছাড়ানোর পর তাকে তার পরিবারের নিকট ফেরত পাঠান। কিন্তু অসুস্থতার ঝুঁকির কারণে তাকে আবার দুধমা হালিমার কাছে পাঠানো হয় এবং মুহাম্মাদ আরও এক-দুই বছর সেখানে থাকে।
মুহাম্মাদ জন্মের পর প্রায় চার বছর পর্যন্ত তার দুধমা হালিমা সাদিয়ার কাছে ছিলেন। তার মা আমিনাও এই সময়ে তার দেখাশোনা করতেন। চার বছর বয়সে তিনি মায়ের কাছে ফিরে আসেন এবং ছয় বছর বয়স পর্যন্ত তার স্নেহ ও যত্নে বেড়ে ওঠেন।[৯৮] ছয় বছর বয়সে, মুহাম্মাদ তার মা আমিনা এবং ধাত্রী উম্মে আইমান এর সাথে তার বাবার সমাধি দেখতে এবং কিছু আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ করতে মদিনায় যাত্রা করেন।[১৬৮] মদিনায় তিনি তার মায়ের আত্মীয় বনু নাজ্জার গোত্রের কাছে এক মাসের জন্য অবস্থান করেন। এরপর মক্কায় ফেরার পথে আবওয়া গ্রামে পৌঁছালে তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন[১৬৮] এবং সেখানেই খুব অল্প বয়সে মারা যান। তাকে সেখানেই সমাহিত করা হয়।[১৬৯] ধাত্রী উম্মে আইমান মুহাম্মাদকে মক্কায় নিয়ে এসে তার দাদা আবদুল মুত্তালিব এর কাছে হস্তান্তর করেন।
ছয় বছর থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত, তার দাদা আবদুল মুত্তালিব তার দেখাশোনা করেন। আবদুল মুত্তালিব বয়সের দিক থেকে আশি বছরেরও বেশি বয়স্ক এক বৃদ্ধ ছিলেন। মুহাম্মাদের আট বছর বয়সে, তার দাদাও অসুস্থ হয়ে মারা যান। মারা যাওয়ার আগে, তিনি তার পুত্র আবু তালিবকে তাকে লালনপালনের জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিছু উৎস বলে যে, আবদুল মুত্তালিব চেয়েছিলেন যে তার দুই পুত্র আবু তালিব এবং যুবায়ের এর মধ্যে কুরা (ভাগ্য নির্ধারণের জন্য লটারি) টেনে মুহাম্মাদের লালনপালনের দায়িত্ব কার হবে তা নির্ধারণ করা হোক এবং কুরা আবু তালিবের পক্ষে এসেছিল।[৯৮] ফলস্বরূপ, মুহাম্মাদ তার বনু হাশিম গোত্রের নবনির্বাচিত নেতা চাচা আবু তালিবের অভিভাবকত্বে আশ্রয় লাভ করেন।[১৭০]
কথিত আছে, মুহাম্মাদ যখন প্রায় ১২ বছর বয়সী ছিলেন, তখন তার চাচা আবু তালিব ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া যান এবং তাকেও সাথে নিয়ে যান। এই ভ্রমণে তিনি বাইজেন্টাইন শাসিত বুসরা শহরে বহিরা নামে একজন খ্রিস্টান সন্ন্যাসীর সাথে পরিচিত হন।[১৭১] ঐতিহ্য অনুসারে, বহিরা শিশু মুহাম্মাদকে পর্যবেক্ষণ এবং তার সাথে কথোপকথন করার পর তার চাচা আবু তালিবকে জানান যে তিনিই হবেন শেষ নবী।[১৭২] এরপর তিনি শিশু মুহাম্মাদকে ইহুদি ও বাইজেন্টাইনদের হাত থেকে রক্ষা করার এবং শামে (তৎকালীন সিরিয়ার নাম) না যাওয়ার পরামর্শ দেন।[১৭১][১৭৩] পরবর্তী বছরগুলোতে, মুহাম্মাদ ১৭ বছর বয়সে তার অন্য চাচা যুবায়ের ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সাথে ব্যবসার উদ্দেশ্যে ইয়েমেনে যান। ধারণা করা হয় যে এই ভ্রমণগুলো মুহাম্মাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং মানসিক ভিত্তি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এছাড়াও তার যৌবনে তিনি তার চাচাদের সাথে কুরাইশ ও কায়েস গোত্রের মধ্যে সংঘটিত ফিজার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এই যুদ্ধগুলোতে তিনি তলোয়ার বাজিয়ে যুদ্ধ না করে ছুঁড়ে আসা তীর সংগ্রহ করে তার চাচাদের হাতে তুলে দিতেন।[১৭৪]
ব্যবসায়িক জীবন ও খাদিজার সাথে বিবাহ
মুহাম্মাদের যৌবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায় কারণ বিদ্যমান তথ্য খণ্ডিত এবং ঐতিহাসিক তথ্য থেকে কিংবদন্তি আলাদা করা কঠিন।[১৭৫][১৭৬] তবে, তিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন এবং ভারত মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে ব্যবসা করতেন বলে জানা যায়।[১৭৭] “ব্যবসায়িক জীবনের পূর্বে, মুহাম্মাদ কিছুকাল তার চাচা আবু তালিবের আর্থিক সহায়তার জন্য পশুপালন করতেন এবং বড় হওয়ার পর ব্যবসায় নিয়োজিত হন।” ব্যবসার প্রতি আগ্রহ তাকে পরবর্তীতে তার স্ত্রী খাদিজার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।[১৭৮] ব্যবসার প্রতি আগ্রহ তাকে পরবর্তীতে তার স্ত্রী খাদিজার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ৫৯৪-৫৯৫ সালে তিনি খাদিজার সাথে অংশীদারিত্বে কাজ শুরু করেন এবং তার মূলধন ব্যবহার করে ব্যবসা পরিচালনা করেন।[১৭৯] ব্যবসায়িক লেনদেনে তার নীতি-নৈতিকতা ও সততার জন্য মক্কার জনগণ তাকে “আল-আমিন” (الامين) বা “বিশ্বস্ত” উপাধিতে ভূষিত করেছিল। এছাড়াও, তিনি মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিরোধের নিরপেক্ষ মীমাংসক হিসেবেও আহ্বান পেতেন।[১৮০]
কয়েকটি ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বের পর, খাদিজা মুহাম্মাদের সততায় মুগ্ধ হন এবং তাকে অত্যন্ত পছন্দ করতে শুরু করেন। তার বান্ধবী নফিসা বিনতে উমাইয়া এর মাধ্যমে তিনি মুহাম্মাদকে বিবাহ করার প্রস্তাব পাঠান। মুহাম্মাদ খাদিজার প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং তার চাচাদের সাথে গিয়ে খাদিজার জন্য আনুষ্ঠানিক বিবাহের প্রস্তাব পাঠান।[১৮১] খাদিজার চাচাও প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন এবং বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহের সময় মুহাম্মাদের বয়স ছিল ২৩-২৫ বছর[১৮২][১৮৩][১৮৪] এবং খাদিজার বয়স ছিল প্রায় ৪০ বছর।[১৮৩][১৮৪] তবে, কিছু উৎসে বলা হয়েছে যে বিবাহের সময় খাদিজার বয়স ছিল ২০-এর শেষের দিকে বা ৩০-এর শুরুর দিকে।[১৮৫] অধিকাংশ ইসলামী পণ্ডিত এই বিকল্প বয়সের তথ্যগুলোকে দুর্বল বলে মনে করেন।[১৮৪]
ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে, মুহাম্মাদ তার যৌবনে তার চারপাশের লোকদের পৌত্তলিক বিশ্বাস ও রীতিনীতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন না।[১৮৬] এই সময়ে তিনি নিজে কোনো মূর্তির পূজা করতেন না, তবে অন্যদের পূজা করার বিরোধিতাও করেননি। মক্কার মানুষের অন্যায়, কুৎসিত, শিরক (বহুঈশ্বরবাদ) এবং মূর্তিপূজায় পূর্ণ জীবনযাত্রা মুহাম্মাদ এর পছন্দ ছিল না। তিনি একাকীত্বে থাকা (ধ্যানমগ্ন) এবং চিন্তাভাবনা করার মাধ্যমে এর সমাধান খুঁজে বের করতেন।
নিম্নোক্ত কুরআনের আয়াতগুলো ইসলাম-পূর্ব মুহাম্মাদ এর অবস্থা ব্যাখ্যা করে:[১৮৭][১৮৮]
আমার নির্দেশের মূল শিক্ষাকে তোমার কাছে আমি ওহি যোগে প্রেরণ করেছি। তুমি জানতে না কিতাব কী, ঈমান কী, কিন্তু আমি একে (অর্থাৎ ওহি যোগে প্রেরিত কুরআনকে) করেছি আলো, যার সাহায্যে আমার বান্দাদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা আমি সঠিক পথে পরিচালিত করি। তুমি নিশ্চিতই (মানুষদেরকে) সঠিক পথের দিকে নির্দেশ করছ। |
— সূরা আশ-শূরা, আয়াত ৫২ |
তিনি আপনাকে পেয়েছিলেন পথের দিশা-হীন, অতঃপর দেখালেন সঠিক পথ। |
— সূরা আদ-দুহা, আয়াত ৭ |
কাবা মধ্যস্থতা
মুহাম্মাদ এর ৩৫ বছর বয়সে, মক্কায় ঘন ঘন বন্যার কারণে কাবার কিছু অংশ ক্ষয়প্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর, “তিনি কাবার মেরামতের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বলে জানা যায়।”[১৮৯]
এই ঘটনার পর কুরাইশ গোত্র কাবা ভেঙে পুনরায় নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।[১৯০] কিন্তু তাদের এই কাজের ফলে দেবতাগণ রুষ্ট হবেন এমন আশঙ্কা দেখা দেয়।[১৯০] আরবদের মধ্যে ইব্রাহিম এর আমল থেকেই কাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জ্ঞাপন একটি পবিত্র কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হম।[১৯১] অবশেষে কুরাইশ গোত্রের এক প্রধান ব্যক্তি হাতে কোদাল নিয়ে এগিয়ে এসে বলেন, “হে দেবী! ভয় পেয়ো না! আমাদের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ভালোর জন্য!” এবং কাবা ভাঙতে শুরু করেন।[১৯০] মক্কার জনগণ সেই রাতে সতর্ক অবস্থায় ছিল এবং তাদের পবিত্র মন্দিরে হস্তক্ষেপ করার জন্য ঈশ্বরের শাস্তি নেমে আসবে কিনা তা ভেবে আতঙ্কিত ছিল। পরদিন সকালে, যখন তারা দেখতে পেল যে ব্যক্তিটি হাতুড়ি দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন তারা এটিকে “ঈশ্বরের অনুগ্রহের নিদর্শন” হিসেবে ব্যাখ্যা করে।[১৯০] এরপর কাবা ইব্রাহিম এর স্থাপিত ভিত্তি পর্যন্ত ভেঙে ফেলা হয় এবং পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু হয়। জেদ্দা উপকূলে একটি জাহাজ ভেঙে গিয়েছিল এবং সেই জাহাজে স্থাপত্যবিদ্যায় পারদর্শী একজন কারিগর ছিলেন। সেই জাহাজের মেরামতের সরঞ্জামও কিনে কাবার নির্মাণে ব্যবহার করা হয়।[১৯১][১৯২]
ইবনে ইশাকের সংগ্রহিত একটি বর্ণনা অনুসারে, পুনর্নির্মাণ প্রায় সম্পূর্ণ হলে, কাবা শরীফের হাজরে আসওয়াদ পাথরটি স্থাপন করার সম্মান কোন গোত্র পাবে তা নিয়ে গোত্রপ্রধানদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। সেখানকার এক বয়স্ক ব্যক্তি প্রস্তাব দেন যে কা’বা অবস্থিত এলাকায়, অর্থাৎ মসজিদুল হারামে প্রবেশকারী পরবর্তী ব্যক্তির পরামর্শ নেওয়া হোক এবং তাকে “হাকেম” নিযুক্ত করা হোক। পরবর্তীতে মসজিদে প্রবেশকারী ব্যক্তি ছিলেন মুহাম্মাদ। সকলে অধীর আগ্রহের সাথে মুহাম্মাদ এর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রইল। মুহাম্মাদ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর একটি চাদর আনার নির্দেশ দেন অথবা নিজের পোশাক খুলে চাদর হিসেবে ব্যবহার করেন। এরপর তিনি পাথরটি চাদরের মাঝখানে রাখেন এবং প্রতিটি গোত্রের গোত্রপ্রধানকে চাদরের এক প্রান্ত ধরে তুলতে বলেন। তারপর তিনি পাথরটি হাতে নিয়ে যথাস্থানে স্থাপন করলেন।[১৯০][১৯২] এই ঘটনা এবং “আহল আল-কিসা”-এ বর্ণিত ঘটনার কারণে মুহাম্মাদ এর আবৃত পোশাক বা চাদর (আবা) পরবর্তীকালে কবি ও লেখকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়ে ওঠে।[১৯৩]
প্রথম ওহী ও কুরআনের সূচনা
মূল নিবন্ধসমূহ: মুহাম্মাদের প্রথম ওহী ও হেরা গুহা |
সীরাতের বর্ণনা অনুসারে, যখন মুহাম্মাদ ৪০ বছর বয়সের কাছাকাছি পৌঁছালেন, তখন তিনি প্রায়শই জনসমাগম থেকে দূরে সরে গিয়ে একাকীত্বে সময় কাটাতে শুরু করেন।[১৯৪] এই অবস্থা প্রায় ১-২ বছর ধরে চলতে থাকে। মুহাম্মাদ মক্কা থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে নূর পর্বতের হেরা গুহায় তার দাদা আবদুল মুত্তালিবের মতো প্রতি বছর কয়েক সপ্তাহ ধরে একা একা থেকে ইতিকাফ (ধ্যান) করতেন।[১৯৫] ইসলামী শিক্ষা অনুসারে, ৬১০ খ্রিস্টাব্দে, রমজান মাসের একটি রাতে (কদর রাত) তিনি হেরা গুহায় চাদর জড়িয়ে ধ্যানে মগ্ন থাকাকালীন আল্লাহর নিকট হতে ফেরেশতা জিবরাঈল এর মাধ্যমে প্রথম ঐশ্বরিক বাণী (ওহী) লাভ করেন।[১৯৬] ফেরেশতা তার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “পড়ো!” কিন্তু মুহাম্মাদ নিরক্ষরতা স্বীকার করে বললেন যে তিনি পড়তে জানেন না। এরপর জিবরাঈল মুহাম্মাদের আরও কাছে এসে তার কথাটি পুনরাবৃত্তি করেন; মুহাম্মাদও পুনরায় বললেন যে তিনি পড়তে জানেন না। এই ঘটনাটি আরও একবার ঘটে। অবশেষে জিবরাঈল নিজেই আয়াতগুলো পড়ে শোনান এবং মুহাম্মাদ সেগুলো মুখস্থ করতে সক্ষম হন।[১৯৭][১৯৮] জিবরাঈল যে আয়াতগুলো পড়ে শুনিয়েছিলেন, সেগুলো পরবর্তীতে কুরআনের ৯৬তম সূরা “সূরা আলাক্ব” এর প্রথম পাঁচটি আয়াতে অন্তর্ভুক্ত হয়। ৬১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্বাবধি মুহাম্মাদ যে ঐশ্বরিক বাণীগুলো (ওহী) লাভ করেছিলেন, সেগুলোই কুরআনের সকল সূরা ও আয়াত গঠন করে। ইসলামে বিশ্বাস, ইবাদত, শরিয়ত, নীতিশাস্ত্র, তাসাউফের মতো অনুশীলন ও বিষয়গুলোর ভিত্তি হিসেবে কুরআনকে ব্যবহার করা হয়।[৯৬][৯৭][১৪৭][১৪৮][১৫৩][১৯৯]
পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট-বাঁধা রক্তপিন্ড হতে। পাঠ করুন, আর আপনার রব মহা মহিমান্বিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না। |
— সূরা আলাক্ব, আয়াত ১-৫, [২০০] |
প্রচলিত রিওয়ায়েত অনুযায়ী, মুহাম্মাদ প্রথম ঐশ্বরিক বাণী (ওহী) লাভ করার পর ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তখন ফেরেশতা জিবরাঈল তার কাছে এসে বলেন যে, তিনি আল্লাহর রাসুল হিসেবে মনোনীত হয়েছেন।[২০১][২০২] এরপর মুহাম্মাদ ঘরে ফিরে স্ত্রী খাদিজাকে ঘটনার বিবরণ জানান। খাদিজা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার পর তাকে তার চাচাতো ভাই ও খ্রিস্টান পাদ্রী ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে নিয়ে যান।[২০৩] ওয়ারাকা মুহাম্মাদকে সান্ত্বনা দেন এবং তাকে শেষ নবী হিসেবে ঘোষণা করেন। অন্যদিকে, শিয়া ঐতিহ্য মুহাম্মাদ এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করে। তাদের মতে, জিবরাঈল এর আবির্ভাবে মুহাম্মাদ ন্যূনতম বিস্মিত বা ভীত হননি, বরং তিনি যেন তার আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন, এমনভাবে তাকে স্বাগত জানান।[২০৪]
প্রথম ঐশ্বরিক বাণীর পর, মুহাম্মাদ এক দীর্ঘ সময় ধরে কোন নতুন বাণী লাভ করেননি। এই সময়কালকে ফাতরাতুল ওহী (ওহী বন্ধ) বলা হয়। এই সময়ে তিনি ধ্যান, প্রার্থনা এবং উপাসনায় মনোনিবেশ করেন। তবে, এই বিরতি তাকে উদ্বিগ্ন ও ভীত করে তোলে।[২০৫] এই অবস্থার কারণে তিনি ব্যাপকভাবে দুঃখিত ও হতাশ বোধ করেন। কিন্তু কিছুদিন পরে, যখন ঐশ্বরিক বাণী পুনরায় শুরু হয়, তখন তিনি স্বস্তি পান এবং নির্দ্বিধায় মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বান জানানোর নির্দেশ লাভ করেন। এই বিষয়ে কুরআনে বেশ কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, যেমন:[২০৬][২০৭]
ওহে বস্ত্র আবৃত (ব্যক্তি)! উঠুন, সতর্ক করুন। আর আপনার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন। |
— সূরা মুদ্দাস্সির, আয়াত ১-৩ |
“ | আপনার প্রতিপালক আপনাকে কক্ষনো পরিত্যাগ করেননি, আর তিনি অসন্তুষ্টও নন। | ” |
— সূরা আদ-দুহা, আয়াত ৩ |
ইসলাম প্রচার, ধর্মগ্রহণ ও প্রতিক্রিয়া
“ | সুতরাং তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা কর এবং ইবাদাত কর। | ” |
— সূরা নাজম, আয়াত ৬২ |
যা মুহাম্মাদের নবুয়ত প্রাপ্তির সূচনালগ্নে অবতীর্ণ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। আয়াতটির একঈশ্বরবাদী নির্দেশনা মক্কার অভিজাত ও পৌত্তলিকদের রীতিনীতির প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছিল
ইসলামী ঐতিহ্য অনুসারে, মুহাম্মাদের আহ্বানে প্রথম সাড়া দেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন তার স্ত্রী খাদিজা, যখন তিনি প্রথম ওহী লাভ করে ঘরে ফিরে আসেন। তারপর তাকে অনুসরণ করেন তার চাচা আবু তালিবের পুত্র আলি, মুক্ত দাস যায়েদ ইবনে হারেসা এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু বকর।[২০৮] এরপর তিন বছর ধরে মুহাম্মাদ কেবল তার আত্মীয়স্বজন এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছেই ইসলামের প্রচার করেন।[২০৯] এরপর, বিশ্বাস অনুসারে, কুরআনে সূরা হিজর এর ৯৪ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর তিনি সাফা পাহাড়ে উঠে সমগ্র মক্কার জনগণকে উন্মুক্তভাবে ইসলাম গ্রহণের ও মুসলিম হওয়ার আহ্বান জানান।
কাজেই আপনাকে যে বিষয়ের হুকুম দেয়া হয়েছে তা জোরে শোরে প্রকাশ্যে প্রচার করুন, আর মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন। |
— সূরা হিজর, আয়াত ৯৪ |
কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া ছিল বেশিরভাগই নেতিবাচক। এই কারণে প্রথম মুসলিমদেরকে ভারী অপমান ও নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়েছিল মক্কার অবিশ্বাসীদের কাছ থেকে, যারা মুহাম্মাদের নবুয়ত প্রাপ্তির বিষয়টিকে প্রথমে সন্দেহের চোখে দেখেছিল। শুরুতে, মুহাম্মাদ মক্কার নেতাদের কাছ থেকে তেমন কোনো বিরোধিতার সম্মুখীন হননি। তারা ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন।[২১০] কিন্তু কিছুদিন পরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। কারণ মুহাম্ম একত্ববাদী বিশ্বাসের প্রচার মক্কার অভিজাতদেড় উদ্বিগ্ন করে তোলে”। তারা মনে করেছিল যে এতে তাদের সামাজিক অবস্থান বিপন্ন হতে পারে।”[২১১] বিশেষ করে কাবা থেকে মূর্তি সরিয়ে ফেলার বিষয়টি তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, “কারণ এটি ধারণা করা হয়েছিল যে এটি তীর্থকেন্দ্রিক বাণিজ্যকে ব্যাহত করবে এবং বহুঈশ্বরবাদী ও পৌত্তলিক রীতিনীতির অবসান ঘটাবে।[২১২] এই সময়ে ইসলাম গ্রহণকারীদের অধিকাংশই তাদের ধর্ম গ্রহণের ব্যপারটি গোপন করতে বাধ্য হয়েছিল।
মুহাম্মাদ কেবল মক্কার বহুঈশ্বরবাদী, পৌত্তলিক ও অবিশ্বাসীদেরই নয়, ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরও তাদের ধর্মের মূলনীতি বিকৃত হয়েছে উল্লেখ করে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান।[২১৩] এই এক ঈশ্বরবাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কেউ কেউ তার আহ্বান গ্রহণ করেছিলেন, আবার কেউ কেউ তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। প্রথম দিকে, মুহাম্মাদ কুরাইশ নেতাদের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হননি। কিন্তু যখন তিনি মূর্তিপূজা-অর্চনার সমালোচনা করে কুরআনের আয়াত পাঠ করতে শুরু করেন এবং পৌত্তলিক (মূর্তিপূজারী) পূজা-অর্চনাকারীদের জাহান্নামে যেতে হবে বলে উল্লেখ করেন, তখন কুরাইশরা তার প্রচারকে একটি বড় বিপদ হিসাবে দেখতে শুরু করে এবং তার একঈশ্বরবাদী বিশ্বাসের প্রতি আহ্বান বন্ধ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে শুরু করে। মুহাম্মাদের দিন দিন অনুসারী বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তাদের পৌত্তলিক বহুঈশ্বরবাদী বিশ্বাস ও আচরণের নিরলসভাবে সমালোচনা করছে দেখে কুরাইশরা তাকে হেয় করতে ও অপমান করতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সহিংসতার আশ্রয় নেয়।[২১০] মক্কী সূরাগুলো বিশ্লেষণ করলে এই প্রতিক্রিয়া এবং সহিংসতার প্রতিফলন দেখা যায়। মুহাম্মাদের ইসলাম প্রচার বন্ধ করার জন্য মক্কার অবিশ্বাসীরা তার চাচা আবু তালিবের সাথে মোট তিনবার সাক্ষাৎ করে। প্রথম সাক্ষাতে, আবু তালিব সৌজন্যতার সাথে তাদের বুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়েছিলেন।[২১৪] দ্বিতীয়বারে যখন কুরাইশরা তাকে চূড়ান্ত হুমকি দিয়েছিল,
আমাদের মধ্যে বয়সে, “সম্মানে ও পদমর্যাদায় আপনি বিশেষ স্থানের অধিকারী। আমরা চেয়েছিলাম যে, “আপনি আপনার ভাতিজাকে বিরত রাখবেন। “কিন্তু আপনি তাকে বিরত রাখেননি। স্রষ্টার কসম! আমরা আর এ ব্যক্তির ব্যাপারে ধৈর্য রাখতে পারছি না। কেননা এ ব্যক্তি আমাদের বাপ-দাদাদের গালি দিচ্ছে, আমাদের জ্ঞানীদের বোকা বলছে, আমাদের উপাস্যদের দোষারোপ করছে। এক্ষণে হয় আপনি তাকে বিরত রাখুন, নয়তো আমরা তাকে ও আপনাকে এ ব্যাপারে একই পর্যায়ে নামাবো। যতক্ষণ না আমাদের দু’পক্ষের একটি পক্ষ ধ্বংস হয়। |
তখন তিনি তার ভাতিজা মুহাম্মাদকে ডেকে এনে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছিলেন,
হে ভাতিজা! তোমার বংশের নেতারা আমাড় কাছে এসেছিলে” এবং তারা এই এই কথা বলেছেন”।… অতএব তুমি আমার উপড়ে এমন বোঝা চাপিয়ো না, “যা বহন করার ক্ষমতা আমার নেই”। |
মুহাম্মাদ তখন কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলেন যে-
হে চাচাজী! যদি তারা আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দেয় একত্ববাদের এই দাওয়াত বন্ধ করার বিনিময়ে, আমি তা কখনোই পরিত্যাগ করব না। যতক্ষণ না আল্লাহ এই দাওয়াতকে বিজয়ী করেন অথবা আমি তাতে ধ্বংস হয়ে যাই। |
মুহাম্মাদ যখন অশ্রুসিক্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন, আবু তালিব তাকে ডেকে বললেন, ‘যাও ভাতিজা! তুমি যা খুশী প্রচার কর। আল্লাহর কসম! কোন কিছুর বিনিময়ে আমি তোমাকে ওদের হাতে তুলে দেব না’। তৃতীয়বার যখন কুরাইশরা এসেছিল, তখন তারা আবু তালিবকে তার ভাতিজাকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, আবু তালিব তীব্রভাবে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এই সময়ে, কিছু কুরাইশেরা ব্যক্তিগতভাবে মুহাম্মাদের সাথে দেখা করে তাকে এই কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে এবং তাকে অর্থ, পদ ও নারীর প্রস্তাব দেয় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।[২১৪]
এই সময়ে, মক্কার দুই শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হামযা “(মুহাম্মাদের চাচা) “ও উমরের পরপর এবং কিছুটা আকস্মিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করা মুসলমানদের মনোবল ও সাহস বৃদ্ধি করে; এর ফলে তারা কাবায় গিয়ে প্রকাশ্যে নামাজ আদায় করে। মুহাম্মাদের চাচা আবু লাহাব ব্যতীত তার অন্যান্য আত্মীয়দের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া এবং মক্কার কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণ, বহুঈশ্বরবাদী ও পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসীদের প্রতিক্রিয়া আরও বৃদ্ধি করে এবং মুসলিমদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তীব্রতর করে।[২১৪] তার অনুসারীদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, মুহাম্মাদ কিছু মুসলমানকে খ্রিস্টান রাজ্য আবিসিনিয়ায় (হাবশা নামেও ডাকা হত; বর্তমান ইথিওপিয়া) হিজরত করার অনুমতি দেন। ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে একদল মুসলিম হাবশায় (আবিসিনিয়া) হিজরত করে। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম হিজরত হিসেবে খ্যাত গুরুত্বপূর্ণ এই ঘটনা মুহাম্মাদের আফ্রিকার সাথেও যোগাযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে।[২১৪]
দুই দফায় আবিসিনিয়ায় হিজরতকারীরা কিছু সময় পর মুহাম্মাদ ও মক্কাবাসীর মধ্যে মীমাংসা এবং সকলের ইসলাম গ্রহণের খবর পান। এই খবর শুনে হিজরতকারীদের কিছু অংশ মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কথিত আছে, মক্কার নিকটে পৌঁছালে তারা একটি কাফেলাকে কি ঘটেছে জিজ্ঞাসা করে। কাফেলা জানায়, মুহাম্মাদ প্রথমে তাদের দেবতাদের প্রশংসা করেছিলেন এবং কুরাইশরা তার কথা মেনে চলেছিল। কিন্তু পরে তিনি দেবতাদের নিন্দা করেন এবং কুরাইশরা আবার তার বিরোধিতা শুরু করে। ইবনে সা’দ কর্তৃক বর্ণিত এই ঘটনাটি ইতিহাসে “গারানিক ঘটনা” নামে পরিচিত এবং কালক্রমে বিভিন্ন রূপে প্রচলিত হয়েছে।[২১৫]
হামযা ও উমরের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে মুসলিমদের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায়, কুরাইশরা তাদের দমন করার জন্য বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য কুরাইশরা বনু হাশিম ও মুত্তালিব গোত্রের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং তাদের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে। কুরাইশরা তাদের সাথে কথা বলা ও লেনদেন করা পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বয়কটের শর্তাবলী লিখে কাবার দেয়ালে টাঙিয়ে দেয়।[২১৪] এর প্রতিক্রিয়ায়, মুহাম্মাদের চাচা আবু তালিব তাকে ও তার অনুসারীদের নিজের মহল্লায় নিয়ে গিয়ে আশ্রয় দেন। মক্কার মুশরিকদের সাথে যোগদানকারী আবু লাহাব ও তার পুত্ররা ব্যতীত মুহাম্মাদের সকল আত্মীয় ৬১৬ থেকে ৬১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সেখানেই বন্দিদশায় বসবাস করতে বাধ্য হয়। এই সমস্ত ঘটনার পরও মুহাম্মাদের নবুয়তের প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় ছিল এবং তিনি আল্লাহর একত্ববাদের প্রচার করে যেতে থাকেন। এই পরিস্থিতি থেকে সাহস নিয়ে তিনি ধর্মীয় ক্ষেত্রে তার ইসলাম প্রচার মক্কার বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার দিকে মনোনিবেশ করেন।
হিজরতের পূর্ববর্তী শেষ বছরগুলো
মূল নিবন্ধসমূহ: দুঃখের বছর, তায়েফ ও মুহাম্মাদের তায়েফ গমন |
৬১৯ সালে কুরাইশদের বনু হাশিম গোত্রের উপর আরোপিত বৃহৎ বয়কট সমাপ্ত হয়। বয়কটের অল্প কিছুদিন পর, মুহাম্মাদের চাচা আবু তালিব এবং তার স্ত্রী খাদিজা তিন দিনের ব্যবধানে মৃত্যুবরণ করেন।[২১৬] তার সবচেয়ে বড় সমর্থক এই দুজন প্রিয়জনের মৃত্যু মুহাম্মাদকে অত্যন্ত দুঃখিত করে।[২১৬] খাদিজা ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন এবং আবু তালিব ছিলেন মক্কার অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে তাঁকে সর্বদা রক্ষাকারী।[২১৬] হাদিস অনুসারে, আবু তালিব মারা যাওয়ার পরে, কুরাইশরা মুহাম্মাদের উপর নির্যাতন আরও তীব্র করে তোলে। তারা তাকে গালি দিত, তাকে নোংরা জিনিস ছুঁড়ে মারত এবং এমনকি তাকে হত্যার চেষ্টা করত। উল্লেখ্য, খাদিজা ও আবু তালিবের মৃত্যুবরণ করা এই বছরটিকে দুঃখের বছর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
আবু তালিব এর মৃত্যুর পর, বনু হাশিম গোত্রের নেতৃত্ব চলে যায় মুহাম্মাদ এর তীব্র শত্রু, তার চাচা আবু লাহাবের হাতে।[২১৭] এরপর থেকে মুহাম্মাদ আরব উপজাতিদের কাছে নিজেকে নবী হিসেবে প্রচার করার এবং তাদের আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে আহ্বান জানানোর জন্য বিভিন্ন বাণিজ্য মেলা ও বাজারে ঘুরতে শুরু করেন।[২১৮] এই ভ্রমণগুলোতে মুহাম্মাদকে অনুসরণ করে আবু লাহাব লোকজনকে বলতেন যে, তিনি “বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন, তার কথা শোনা উচিত নয় এবং তাকে উপেক্ষা করা উচিত।”[২১৭] অল্প কিছুদিন পর, আবু লাহাব মক্কার মুশরিকদের সহায়তায় গোত্রের মুহাম্মাদ এর উপর প্রদত্ত সুরক্ষা প্রত্যাহার করে নেয়।[২১৮] এই ঘটনা মুহাম্মাদকে মারাত্মক বিপদে ফেলে দেয় কারণ গোত্রের সুরক্ষা প্রত্যাহারের অর্থ ছিল যে, তাকে হত্যা করলে তার জন্য কোন রক্তপাতের প্রতিশোধ নেওয়া হবে না।
উল্লেখিত ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে মুহাম্মাদ আরবের আরেক গুরুত্বপূর্ণ শহর তায়েফ যাত্রা করেন এবং সেখানে একজন গোত্রীয় সুরক্ষাদাতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তায়েফে তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তাকে আরও বেশি শারীরিক বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। তার পালিত পুত্র যায়েদ ইবনে হারেসার সাথে তাকে পাথর নিক্ষেপ করে ভয়াবহরকমভাবে আহত করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।[২১৯][২২০] অবশেষে মুহাম্মাদ মক্কায় ফিরে যেতে বাধ্য হন। মুহাম্মাদ যখন মক্কায় ফিরছিলেন, তখন তায়েফের ঘটনাবলীর খবর আবু জাহেলের নিকট পৌঁছেছিল। সে বলল, “তারা তাকে তায়েফে প্রবেশ করতে দেয়নি, তাই আমরাও তাকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেবো না।” পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরে, মুহাম্মাদ একজন চলতি ঘোড়সওয়ারকে তার মায়ের গোত্রের সদস্য আখনাস ইবনে শুরায়কের কাছে বার্তা পৌঁছানোর অনুরোধ করেন। মুহাম্মাদ চেয়েছিলেন আখনাস তাকে নিরাপদে মক্কায় ঢোকার সুরক্ষা দেবেন। কিন্তু আখনাস তা প্রত্যাখ্যান করেন, এই বলে যে তিনি কেবল কুরাইশদের একজন মিত্র। এরপর মুহাম্মাদ সুহাইল ইবনে আমরের কাছে বার্তা প্রেরণ করেন, যিনি গোত্রীয় মর্যাদার কারণে তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরিশেষে, মুহাম্মাদ বনু নওফালের প্রধান মুতইম ইবনে আদির কাছে সুরক্ষার অনুরোধ পাঠান। মুতইম সম্মত হন এবং নিজেকে অস্ত্রসজ্জিত করে সকালে তার ছেলে ও ভাইপোদের সাথে মুহাম্মাদকে শহরে নিয়ে আসার জন্য রওনা দেন। আবু জাহেল তাকে দেখে জিজ্ঞাসা করে যে মুতইম কেবল তাকে সুরক্ষা দিচ্ছেন, নাকি ইতোমধ্যে তিনি তার ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। মুতইম জবাবে বললেন, “অবশ্যই তাকে সুরক্ষা দিচ্ছি।” এরপর আবু জাহেল বলল, “তুমি যাকে রক্ষা করবে, আমরাও তাকে রক্ষা করব।” এভাবে মুহাম্মাদ নিরাপদে তার নিজ শহরে পুনঃপ্রবেশ করতে সক্ষম হন।[২২১]
আকাবার শপথ
মূল নিবন্ধসমূহ: আকাবার প্রথম শপথ ও আকাবার দ্বিতীয় শপথ |
আরব উপদ্বীপের বহু মানুষ এই নতুন ধর্ম ও এর নবী সম্পর্কে শুনেছিল এবং ব্যবসা বা কাবায় তীর্থের মতো কারণে মক্কা ভ্রমণ করতে আসত। প্রথমবার মক্কায় আসা প্রায় ১২ জন (আকাবার প্রথম শপথ) এবং এরপর আবার মক্কায় আসা প্রায় ৩০০ জন (আকাবার দ্বিতীয় শপথ); ৬২০-৬২১ সালে ‘আকাবা’ নামক স্থানে, যা মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে, মুহাম্মাদ এর সাথে গোপনে সাক্ষাৎ করে তাকে ইসলাম গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে ইয়াসরিবে (যা পরবর্তীতে মদিনা নামে পরিচিত) আমন্ত্রণ জানায়।[২২২] মুহাম্মাদ এই সুযোগটি নিজে এবং তার অনুসারীদের জন্য নতুন আশ্রয় খুঁজে পেতে ব্যবহার করেন। ইয়াসরিবের (মদিনা) আরব জনগোষ্ঠী এক ঈশ্বরে বিশ্বাসের সাথে পরিচিত ছিল, কারণ শহরে একটি ইহুদি সম্প্রদায় ছিল।[২২৩] এছাড়াও ইয়াসরিবের জনগণ মুহাম্মাদ এবং এই নতুন ধর্মের মাধ্যমে মক্কার উপর আধিপত্য বিস্তার করার আশা করেছিল। কারণ তীর্থস্থান হওয়ার কারণে মক্কার গুরুত্বের জন্য ইয়াসরিববাসী ঈর্ষা করত।[২২৪][২২৫]
আকাবায় প্রতিশ্রুতির পর মুহাম্মাদ ইয়াসরিবকে উপযুক্ত মনে করেছিলেন এবং তার অনুসারীদের সেখানে হিজরত করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।[২২৬] পূর্বে হাবশায় যে হিজরত হয়েছিল, ঠিক তেমনি কুরাইশরা আবার এই হিজরত বন্ধ করার চেষ্টা করবে, কিন্তু প্রায় সকল মুসলিম হিজরত করতে সক্ষম হবে।
মদিনায় হিজরত
মূল নিবন্ধ: হিজরত |
এই সময়ের মধ্যে, মক্কার মুসলমানরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মদিনায় হিজরত করতে শুরু করে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মক্কার অধিকাংশ মুসলমান মদিনায় স্থানান্তরিত হয়। শহরে শুধুমাত্র মুহাম্মাদ এবং আবু বকর ও তাদের পরিবার, আলি এবং তার মা এবং কিছু বয়স্ক মুসলমান এবং যারা মক্কাবাসীদের নির্যাতনের শিকার হয়ে বন্দি ছিল তারা অবশিষ্ট ছিল।[২২৭] মুহাম্মাদ এই কঠিন ও দীর্ঘ যাত্রার জন্য তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু বকরকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন এবং তাকে দ্রুত প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি তার চাচাতো ভাই আলিকে তার অপরিশোধিত ঋণ পরিশোধ করার জন্য এবং তার কাছে থাকা কিছু আমানত মালিকদের কাছে ফেরত দেওয়ার জন্য পিছনে রেখে যেতে চেয়েছিলেন।
মক্কার কুরাইশরা যখন দেখতে পেল যে তারা মুহাম্মাদকে তার একঈশ্বরবাদী প্রচারণা থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং মদিনায় অবস্থিত মুসলমানরা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তখন তারা আশঙ্কা করতে শুরু করল যে এই পরিস্থিতি তাদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এই উদ্বেগের ভিত্তিতে তারা “দারুন-নদওয়া” নামক একটি সভায় মিলিত হয় এবং এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে।[২২৮] আলোচনায় তারা উল্লেখ করে যে ইসলাম দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী পৌত্তলিক রীতিনীতি ও ব্যবস্থার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। সর্বোপরি, তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে মুহাম্মাদকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে। এই কাজের জন্য বিভিন্ন গোত্র থেকে কয়েকজন শক্তিশালী তরুণ যুবককে নির্বাচিত করা হয়।
মুহাম্মাদ সেই রাতে যখন মক্কার কুরাইশদের হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার খবর পেলেন, তখন তিনি তার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আলি তখন মুহাম্মাদ এর পোশাক পরে তার বিছানায় শুয়ে পড়েন। এতে করে হত্যাকারীরা ভেবেছিল যে মুহাম্মাদ এখনও ঘরেই আছেন।[২২৯] কিন্তু যখন হত্যাকারীরা সত্যিটা জানতে পারল, তখন মুহাম্মাদ ইতিমধ্যেই আবু বকর এর সাথে মক্কা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। মুহাম্মাদ এর চাচাতো ভাই আলি এই ষড়যন্ত্র থেকে জীবিত রক্ষা পান। তবে মুহাম্মাদ এর নির্দেশাবলী পালন করার জন্য তিনি কিছুদিনের জন্য মক্কায় অবস্থান করেন।[২৩০] পরে আলি তার মা ফাতিমা বিনতে আসাদ, মুহাম্মাদ এর কন্যারা, স্ত্রী সাওদা বিনতে জামআ, ধাত্রী উম্মে আইমান এবং বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে পড়া অন্যান্য মুসলমানদের সাথে যাত্রা শুরু করেন।[২৩০]
মক্কার মুশরিকরা যখন মুহাম্মাদকে তার বাড়িতে খুঁজে না পেয়ে “এবং এরপর আবু বকর এর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েও কোন ফলাফল না পেয়ে হতাশ হলো, তখন তারা চারপাশের সব এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও তল্লাশি করতে শুরু করলো। তারা মুহাম্মাদ ও আবু বকর এর মাথার দাম ঘোষণা করে চারদিকে প্রচারক পাঠালো।[২২৭] “এই সময় মুহাম্মাদ এবং আবু বকর শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সাওর পর্বতের একটি গুহায় তিন দিন লুকিয়ে ছিলেন। “পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে তারা কৃষ্ণ সাগরের দিকে তুলনামূলক নিরাপদ পথে যাত্রা শুরু করেন।[২২৭] “মদিনায় নিরাপদে পৌঁছাতে তারা প্রধান ও ব্যস্ত রাস্তার পরিবর্তে বিকল্প পথ বেছে নেন এবং পাহাড়ি গিরিপথ ও মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাত্রা করেন। “তবুও, মদিনায় পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত মক্কার মুশরিকদের তল্লাশি থেকে মুক্তি পেতে তাদের অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয় এবং মাঝে মাঝে প্রাণের ঝুঁকিও নিতে হয়।
মুহাম্মাদ এবং আবু বকর তাদের যাত্রার শেষ পর্যায়ে মদিনার কাছে কুবা নামক একটি গ্রামে পৌঁছান। সেখানে মুহাম্মাদ কে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয় এবং তিনি পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী কুলসুম ইবনে হিদম এর বাড়িতে অতিথি হিসেবে অবস্থান করেন। কিছু তথ্য অনুসারে, মুহাম্মাদ সেখানে চার দিন এবং অন্য তথ্য অনুসারে দশ দিন অবস্থান করেন।[২৩১] এই সময়ের মধ্যে, তিনি কুবায় নিজেও নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে মসজিদে কুবা নামে পরিচিত এই মসজিদটি ইসলামের ইতিহাসে নির্মিত প্রথম মসজিদ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। এই সময়ে আলি এবং তার সাথে থাকা মুসলমানরাও কুবায় পৌঁছান। এরপর মুহাম্মাদ ও অন্যরা সকলে একসাথে কুবা থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং অবশেষে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর মদিনায় পৌঁছান।[২২৭]
মদিনার জীবন
মূল নিবন্ধ: মদিনায় মুহাম্মাদ |
৬২২ সালে মুহাম্মাদ যখন মদিনায় পৌঁছান, তখন স্থানীয় মুসলমানরা তাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায়। প্রত্যেক মুসলিম তাকে নিজ বাড়িতে অতিথি হিসেবে রাখতে চেয়েছিল। অবশেষে, তার উট যেখানে বসে পড়ে, সেই স্থানের কাছেই বসবাসকারী আবু আইয়ুব আনসারি-এর বাড়িতে তিনি অবস্থান করেন।[২৩২] মুহাম্মাদ মদিনায় একটি মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন এবং তার পরিবারের জন্য মসজিদের পাশে ঘর তৈরি করেন। মসজিদের এক পাশে বেঘরদের থাকার জন্য “সুফফাহ” নামে একটি স্থান তৈরি করা হয়। এখানে থাকা ব্যক্তিদের “আসহাবুস সুফফাহ” বলা হত। পরবর্তীতে “মসজিদে নববী” নামে পরিচিত এই মসজিদটি মুহাম্মাদের মদিনার সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এটি পরবর্তী যুগে নির্মিত মসজিদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে ওঠে।[২৩৩]
মদিনার সনদ এবং মদিনা শহর রাষ্ট্র
মূল নিবন্ধ: মদিনার সনদ
মদিনা (যার আসল নাম “ইয়াসরিব” ছিল, মুসলমানরা শহরটিকে “মদিনাতু’ন নবি” এবং পরে সংক্ষেপে “মদিনা” বলে অভিহিত করেছিল) জনসংখ্যা ছিল “মুহাজির” নামে পরিচিত মক্কার অভিবাসী, “আনসার” নামে পরিচিত স্থানীয় জনগোষ্ঠী (বিশেষ করে ইয়েমেন বংশোদ্ভূত বনু আউস এবং বনু খাযরাজ গোত্র) এবং বনু কুরাইজা, বনু কায়নুকা ও বনু নাদির নামে পরিচিত ইহুদি গোত্র থেকে। তাদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা বেশ কঠিন ছিল। খায়বারের মতো মদিনার সীমানা সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী ইহুদিরা ধনী ব্যক্তি ছিলেন বলে তারা আশেপাশের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। আউস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে শেষবার ৬১৭ সালে সংঘটিত ঐতিহ্যবাহী শত্রুতা পুনরায় জাগরিত হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। এছাড়াও, আনসার ও মুহাজিরদের একত্রিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল।
মুহাম্মাদ এই সকল শ্রেণীকে একত্রিত ও সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে ছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল অত্যন্ত দরিদ্র অভিবাসীদের অবস্থার উন্নতি করা। মুহাম্মাদ মুহাজিরদের স্থানীয় জনগণের সাথে ভ্রাতৃত্ব ঘোষণা করে তাদের সাহায্য করার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইহুদিদের সাথে তার মতবিরোধ মিটিয়ে তিনি আশেপাশে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিভিন্ন শ্রেণীর অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ করে ৪৭ ধারার “মদিনা সংবিধান” গ্রহণ করা হয়। এই সংবিধান মূলত এলাকার গোত্রীয় বিষয়গুলোকে সমাধান করে মদিনায় একটি বহু-ধর্মীয় ইসলামী রাষ্ট্র, অর্থাৎ মদিনা শহর রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে;[২৩৪] এবং মুহাম্মাদ এই শাসনের প্রধান নির্বাচিত হন।
যদিও বেশিরভাগ পশ্চিমা ও মুসলিম পণ্ডিত মদিনার সংবিধানের লেখার বাস্তবতা সম্পর্কে একমত, এর প্রকৃতি – একটি চুক্তি নাকি মুহাম্মাদের একতরফা ঘোষণা, নথির সংখ্যা, প্রাথমিক পক্ষ, এবং লেখার নির্দিষ্ট সময়কাল – নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে।[২৩৫] জার্মান ধর্মতত্ত্ববিদ এবং প্রাচ্যবিদ জুলিয়াস ওয়েলহাউসেন ৪৭টি ধারার একটি সংস্করণ প্রস্তাব করেছিলেন, যা বেশিরভাগ পরবর্তী গবেষক অনুসরণ করেছেন। ভারতীয় পণ্ডিত মোহাম্মদ হামিদুল্লাহ ৫২টি ধারার সংস্করণ প্রস্তাব করেছিলেন, ওয়েলহাউসেনের ৪৭টি ধারা গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু কিছু ধারাকে দুটি অংশে বিভক্ত করেছিলেন।[২৩৬] ইসরায়েলি পণ্ডিত মাইকেল লেকার ৬৪টি ধারার সংস্করণ প্রস্তাব করেছিলেন। ব্রিটিশ পণ্ডিত রবার্ট বি. সার্জেন্ট ৮টি আলাদা অংশ এবং মোট ৭০টি ধারার সংস্করণ প্রস্তাব করেছিলেন।
মুসলিম পণ্ডিতদের বর্ণনা অনুসারে, বিসমিল্লাহ-এর সাথে শুরু হওয়া দলিলের প্রথম ধারাটি নিম্নরূপ:[২৩৬]
“ এই দলিলটি নবী মুহাম্মাদ কর্তৃক কুরাইশ ও ইয়াসরিবের মুমিনদের জন্য, তাদের অনুসারীদের জন্য, যারা পরবর্তীতে তাদের সাথে যোগদান করেছিল এবং তাদের সাথে জিহাদ করেছিল তাদের জন্য প্রণীত। ”
— মদিনার সনদ, ধারা ১
মদিনার সনদ, ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ কর্তৃক প্রণীত একটি ঐতিহাসিক দলিল যা মদিনার বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি ও সহাবস্থান প্রতিষ্ঠা করে। এর ২৫নং ধারাটি বেশ আকর্ষণীয়, কারণ এতে ইহুদি গোষ্ঠীগুলোকে “উম্মাহ”-এর অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং উভয় সম্প্রদায়ের জন্য নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।[২৩৬] ওয়াশবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এল. আলি খান এই দলিলকে একটি “সামাজিক চুক্তি” হিসেবে বর্ণনা করেছেন যা একটি “সনদের” উপর ভিত্তি করে তৈরি। খানের মতে, এই দলিলটি “এক ঈশ্বরের আধিপত্যের অধীনে বসবাসকারী বিভিন্ন গোষ্ঠী দ্বারা গঠিত একক সম্প্রদায়ের ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।”[২৩৭] মদিনার সংবিধানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মুসলমানদের মধ্যকার সম্পর্কের পুনর্নির্ধারণ। এই দলিলের মাধ্যমে মুসলমানরা রক্তের সম্পর্কের চেয়ে তাদের বিশ্বাসকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করে।[২৩৮] গোষ্ঠী পরিচয় বিভিন্ন গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করার জন্য এখনও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তবে নতুন করে গঠিত “উম্মাহ”-এর জন্য প্রধান সংযোগকারী শক্তি ছিল “ধর্ম”।[২৩৯] কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন “উম্মাহ” নামক এই নতুন সম্প্রদায়কে একটি নতুন গোষ্ঠীর সাথে তুলনা করা যেতে পারে, তবে এর একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো এটি রক্তের সম্পর্কের পরিবর্তে ধর্মের উপর ভিত্তি করে তৈরি।[২৩৯] এই বৈশিষ্ট্যটি গোষ্ঠী-ভিত্তিক সমাজে গঠিত ইসলাম পূর্ব আরবের রীতিনীতির সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। মদিনার এই ছোট মুসলিম গোষ্ঠীটির পরবর্তীতে একটি বিশাল মুসলিম সম্প্রদায় ও সাম্রাজ্যে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল।[২৪০
মদিনার সংবিধান, যা মিসাক-ই-মদিনা নামেও পরিচিত, ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এটি ৬২২ সালে মুহাম্মাদ কর্তৃক প্রণীত হয়েছিল এবং মদিনার বিভিন্ন ধর্মীয় ও গোষ্ঠীগত সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও সহাবস্থান প্রতিষ্ঠার জন্য নীতি নির্ধারণ করে। এই সংবিধানে অমুসলিমদের অধিকার বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ধর্মীয় সহনশীলতা ও ন্যায়বিচারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মদিনার সংবিধান অনুসারে মদিনায় বসবাসকারী অমুসলিমদের নিম্নলিখিত অধিকার ছিল:[২৪১]
ধর্মীয় স্বাধীনতা:
অমুসলিমদের তাদের নিজস্ব ধর্ম পালন করার পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন, ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণ ও সংরক্ষণ এবং ধর্মীয় নেতা নির্বাচনের অধিকার ছিল। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য তাদের কখনোই হয়রানি করা হত না।
রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা:
মদিনার রাষ্ট্র অমুসলিমদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিত। বাইরের আক্রমণ থেকে মদিনা রক্ষা করার জন্য অমুসলিমদেরও সাহায্য করতে হত।
রাজনৈতিক অধিকার:
অমুসলিমদের মদিনার রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে অংশগ্রহণের অধিকার ছিল। তাদের নিজস্ব বিষয়ে স্বায়ত্তশাসন করার অধিকার ছিল। মুসলিমদের সাথে তাদের সমান অধিকার ছিল।
অর্থনৈতিক অধিকার:
অমুসলিমদের তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। তাদের সম্পত্তির মালিকানা ও উত্তরাধিকারের অধিকার ছিল। মুসলিমদের সাথে তাদের সমান অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ছিল।
সামাজিক অধিকার:
অমুসলিমদের মদিনার সমাজে সম্মানের সাথে বসবাস করার অধিকার ছিল। তাদের মুসলিমদের সাথে সমান সামাজিক ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার ছিল।
প্রথম জনগণনা এবং যুদ্ধের দিকে
মদিনায় শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পর মুহাম্মাদ একটি জনশুমারি পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ মক্কার কাফেরদের সাথে যুদ্ধ এখন সময়ের ব্যাপার ছিল এবং এর জন্য মুসলমানদের সংখ্যার সঠিক তথ্য জানা প্রয়োজন ছিল।[২৪৩] সাহাবীদের সাথে আলোচনার পর মুহাম্মাদ তাদের মধ্যে কয়েকজনকে দায়িত্ব দেন এবং মুসলমানদের নাম ও সংখ্যা জানতে চান।[২৪৪] বিভিন্ন বর্ণনামতে এই সংখ্যা ৫০০ থেকে ১৫০০ এর মধ্যে বলা হয়েছে।[২৪৩] তবে ধারণা করা হয় মুসলমানদের মোট সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫০০ জন, যার মধ্যে ৬০০-৭০০ জন ছিল পুরুষ এবং ৫০০ জন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য সক্ষম।[২৪৩][২৪৪]
এই সময়ে, বিশ্বাস অনুযায়ী, “সূরা হাজ্জ্ব-এর ৩৯ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হয় যার মাধ্যমে মুসলমানদের যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়। মুহাম্মাদ এবং অন্যান্য মুসলমানদের হিজরতের পূর্বে ১২ বছরের সময়কালে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়নি, শুধুমাত্র. “ধৈর্য ধারণ” করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এর আরেকটি কারণ ছিল মুসলমানদের পর্যাপ্ত সামরিক শক্তির অভাব। হিজরতের প্রথম বা দ্বিতীয় বছরে, বিশ্বাস অনুযায়ী, কেবলমাত্র মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত কুরআন আয়াতের মাধ্যমে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়:[২৪৫][২৪৬]
যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে, “যাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে। কারণ তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। “নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দানে সক্ষম। |
— সূরা হাজ্জ্ব, আয়াত ৩৯ |
সশস্ত্র সংঘাতের সূচনা: বদর যুদ্ধ
মূল নিবন্ধসমূহ: বদরের যুদ্ধ ও মুহাম্মাদের সামরিক জীবন |
মক্কার কুরাইশরা মুসলিমদের উপর নির্যাতন চালাত এবং তাদের মদিনা থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করত। মুসলমানদের একটি বাণিজ্য কাফেলাকে লুণ্ঠন করারও চেষ্টা করেছিল কুরাইশরা। মুহাম্মাদ যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন মক্কার কাফেররা মদিনায় অভিবাসী মুসলমানদের সম্পত্তি লুণ্ঠন করে। যুদ্ধের অনুমতি দেয় এমন আয়াত নাজিল হওয়ার পর, এই লুণ্ঠনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এবং মুসলমানদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার সমাধান করার জন্য মুসলমানরা মক্কার কাফেলা আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।[১৫৩] ৬২৪ সালের মার্চ মাসে, হজরত মুহাম্মাদ খবর পেলেন যে, মক্কার একটি বড় বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে।[২৪৭] এই কাফেলায় প্রায় ১০০০টি উট এবং ৫০,০০০ দিনার মূল্যের সম্পদ ছিল। কাফেলাটি ৭০ জন সশস্ত্র লোক দ্বারা রক্ষিত ছিল এবং এর নেতৃত্বে ছিলেন আবু সুফিয়ান।[২৪৭]
মুহাম্মাদ যখন এই বিশাল কাফেলা সম্পর্কে শুনলেন, তিনি তার সাহাবীদের একত্রিত করেন। তিনি কাফেলায় থাকা বিপুল পরিমাণ পণ্যসম্ভারের কথা তুলে ধরেন এবং তাদের বলেন যে ফেরার পথে তারা কাফেলাটি আটকাতে পারে। এজন্য তিনি অভিযানে অংশগ্রহণের জন্য সাহাবীদের প্রস্তুতি নিতে বলেন।[২৪৮] ফলস্বরূপ, মুহাম্মাদ ৬২৪ সালের ৮ই মার্চ, প্রায় ৩১০ জনের একটি বাহিনী নিয়ে মদিনা থেকে রওনা হন। সিরিয়া থেকে ফেরার পথে আবু সুফিয়ান খবর পান যে মুসলিমরা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি মক্কায় সাহায্যের জন্য একজন অশ্বারোহী প্রেরণ করেন[২৪৮] এবং কাফেলার গতিপথ পরিবর্তন করেন। আবু সুফিয়ানের পাঠানো খবর পেয়ে, কুরাইশ গোত্রের প্রায় ৯৫০ জন মক্কা থেকে আবু জেহেলের নেতৃত্বে রওনা হয়।
মুসলমানরা একটি বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে – এই খবর পেয়ে মক্কার অধিবাসীরা তাদের বাহিনী প্রস্তুত করে। এরপর আবু সুফিয়ান, বাণিজ্য কাফেলার নেতা, মক্কায় দ্বিতীয়বার বার্তা পাঠিয়ে জানান যে বিপদ এড়িয়ে গেছে। কিন্তু মক্কার নেতারা যুদ্ধের সিদ্ধান্ত বদলাননি। ৯৫০ জনের একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে তারা বদরের দিকে রওনা হন। এদিকে, মুহাম্মাদ এবং তার অনুসারীরা এখনও জানতেন না যে কুরাইশ বাহিনী মক্কা থেকে বেরিয়ে বদরের দিকে এগিয়ে আসছে। ৬২৪ সালের ১৪ই মার্চ দুই বাহিনী বদরে মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ শুরুর আগে, আরব যুদ্ধের ঐতিহ্য অনুযায়ী, “দ্বন্দ্বযুদ্ধ” (মুবারাজা) অনুষ্ঠিত হয়। এর জন্য উভয় পক্ষ থেকে তিনজন করে যোদ্ধা নির্বাচিত হয়।[২৪৯] মুসলিম বাহিনীর পক্ষ থেকে হামযা, উবাইদাহ ইবনে হারিস এবং আলি; এবং মক্কার পক্ষ থেকে উতবা, তার ভাই শায়বা এবং তার পুত্র ওয়ালিদ যুদ্ধে অংশ নেন। হামজা এবং আলী তাদের প্রতিপক্ষদের পরাজিত করেন। উবাইদা উতবার সাথে সমানে লড়াই করলেও আহত হন। এরপর হামজা এবং আলী উবাইদার সাহায্যে এগিয়ে এসে উতবাকে হত্যা করেন।[২৪৮]
বদরের যুদ্ধ হিজরতের দ্বিতীয় বছরের রমজান মাসের ১৭ তারিখে (১৭ মার্চ ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ) সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধের পূর্বে ৬২৩ থেকে ৬২৪ সালের মধ্যে মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে বেশ কিছু খন্ডযুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের কারণ ছিল মক্কার কুরাইশদের মুসলমানদের উপর নির্যাতন এবং মুসলিমদের একটি বাণিজ্য কাফেলা আটক করার চেষ্টা। যুদ্ধের শুরুতে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১০ জন, কিন্তু মক্কার কুরাইশদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৯৫০ জন। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে মুসলমানরা কঠিন প্রতিরোধ করে। কুরাইশদের সেনাপতি আবু জাহেল যখন নিহত হন, তখন তারা পালিয়ে যেতে শুরু করে। কয়েক ঘন্টা স্থায়ী এই যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হয়। কিছু আধুনিক ইতিহাসবিদ, যেমন রিচার্ড এ. গ্যাব্রিয়েল, মনে করেন মুহাম্মাদের কৌশলগত সামরিক কৌশল এবং মুসলমানদের সাহসই এই বিজয়ের মূল কারণ।[২৫০] অন্যদিকে, কুরআনের কিছু আয়াত এবং পরবর্তীকালের কিছু বর্ণনা অনুসারে, যুদ্ধের সময় মুসলমানদের সাহায্য করার জন্য হাজার হাজার ফেরেশতা পাঠানো হয়েছিল।[২৫১]
বদরের যুদ্ধ ছিল মুসলিমদের মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে প্রথম জয়।[২৫২] যুদ্ধে মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন এবং কুরাইশদের সংখ্যা ছিল ১০০০ জনেরও বেশি। যুদ্ধে মুসলমানরা ৭০ জন পৌত্তলিককে হত্যা করে এবং ৭০ জনকে বন্দি করে। মুসলমানদের মাত্র ১৪ জন শহীদ হন। যুদ্ধের পর মুহাম্মাদ বন্দিদের সাথে উদার আচরণ করার নির্দেশ দেন। বন্দীদের মধ্যে মাত্র দু’জনকে মুসলিমদের উপর নির্যাতনের প্রতিশোধ হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।[২৪৮] অন্যান্য বন্দীদের তাদের আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করে অর্থ প্রদানের শর্ত আরোপ করা হয়। যারা মুক্তিপণ দিতে পারত তাদের মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়। যারা মুক্তিপণ দিতে পারত না তাদের ১০ জন করে মুসলমানকে পড়া-লেখা শেখানোর শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মক্কার কাফেররা নিহত নেতা আবু জাহেলের পরিবর্তে আবু সুফিয়ানকে তাদের নতুন নেতা হিসেবে নির্বাচিত করে।[২৪৮] বদর যুদ্ধ মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় ছিল। এটি তাদের মনোবল বৃদ্ধি করে এবং ইসলামের প্রসারের পথ সুগম করে। এই যুদ্ধের পর মক্কার কুরাইশরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে আরও তীব্রভাবে শত্রুতা পোষণ করতে শুরু করে।[২৪৮]
উহুদের যুদ্ধ
মূল নিবন্ধ: উহুদের যুদ্ধ |
মক্কার কাফিররা বদর যুদ্ধে মুসলিমদের কাছে পরাজিত হয়েছিল। এই পরাজয়ের ক্ষোভ তাদের মনে গেঁথে ছিল। কারণ, এই যুদ্ধের পর শামের বাণিজ্যপথ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং মুসলিমরা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মক্কার কাফেররা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে দ্বিতীয় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ২০০ জন অশ্বারোহী, ৭০০ জন বর্মধারী সহ মোট ৩,০০০ জনের একটি সৈন্য তৈরি করা হয় এবং যাত্রা শুরু করা হয়।[২৫৩] মুহাম্মাদ এর চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব তখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন। তিনি মক্কার যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পর্কে একটি চিঠি লিখে মদিনায় পাঠান। চিঠি পেয়ে মুহাম্মাদ যুদ্ধ কীভাবে পরিচালনা করা হবে তা নিয়ে সাহাবীদের সাথে আলোচনা শুরু করেন এবং এরপর মক্কা বাহিনীর মোকাবিলায় সৈন্য বাহিনী প্রস্তুত করা হয়।[২৫৩]
মক্কার সৈন্যবাহিনী, ৬২৫ সালের ১১ মার্চ মক্কা থেকে মদিনার দিকে যাত্রা শুরু করে। এই আক্রমণে মক্কাবাসীর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল গত বছর সংঘটিত বদর যুদ্ধে তাদের ক্ষয়ক্ষতির প্রতিশোধ নেওয়া এবং মুসলিমদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে দমন করা। মুসলিমরাও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। কিছুক্ষণ পর দুই বাহিনী উহুদ পর্বতের পাদদেশে ও সমতলে মুখোমুখি হয়।[২৫৪] মুহাম্মাদ উহুদ পর্বতের একটি সংকীর্ণ গিরিখাতের দুই পাশে তার তীরন্দাজদের মোতায়েন করেন।[২৫৪] এই কৌশলের মাধ্যমে তিনি মক্কা বাহিনীর উহুদ পর্বতের চারপাশে ঘুরে মুসলিমদের উপর সম্ভাব্য আক্রমণের সম্ভাবনা রোধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি তার তীরন্দাজদের নির্দেশ দেন, “নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা তোমাদের অবস্থান ত্যাগ করবে না!” মুসলিমদের সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০০ জন।[২৫৪]
উহুদ পর্বতের পাদদেশে দুই পক্ষের বাহিনী মুখোমুখি হয়।[২৫৫] যুদ্ধের শুরুতে মুসলিমদের জোরালো আক্রমণের মুখে মক্কার বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। এই দৃশ্য দেখে, মুসলিম বাহিনীর ধনুর্ধররা ভেবে নেয় যে যুদ্ধ শেষ হয়েছে এবং তারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে যাওয়া মক্কার বাহিনীর সম্পদ সংগ্রহ করতে শুরু করে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে খালিদ বিন ওয়ালিদ তার বাহিনী নিয়ে ধনুর্ধরদের ফাঁকা অবস্থান দিয়ে মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণ করে।[২৫৫] এই আক্রমণে মুসলিম বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং পিছু হটতে শুরু করে। পিছু হটতে থাকা মক্কার বাহিনী এই সুযোগে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে এসে মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণ করে। মুসলিম বাহিনী উহুদ পর্বতের দিকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পর্বতে আশ্রয় নেওয়া মুসলিম বাহিনী তীরন্দাজদের সাহায্যে মক্কার বাহিনীকে পিছু হটাতে সক্ষম হয়। মক্কার বাহিনীও নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করতে ব্যর্থ হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে।[২৫৫]
উহুদের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর ৭০ জন সৈনিক শহীদ হয় এবং মক্কার বাহিনীর ৪৪-৪৫ জন সৈনিক নিহত হয়।[২৫৪] এই যুদ্ধে মুহাম্মাদ গুরুতর আহত হন এবং তার চাচা হামযা সহ আরও অনেক মুসলিম শহীদ হন। মক্কার বাহিনীর নেতা আবু সুফিয়ান এই যুদ্ধকে বদর যুদ্ধের প্রতিশোধ হিসেবে ঘোষণা করে।[২৫৩]
খন্দক যুদ্ধ
মূল নিবন্ধ: খন্দকের যুদ্ধ |
৬২৭ “খ্রিষ্টাব্দের “৩১ শে মার্চ, ১০,০০০ সৈন্য এবং ৬০০ “অশ্বারোহী নিয়ে মদিনা আক্রমণ করতে আসে মক্কার বাহিনী।”[২৫৬][২৫৭][২৫৮] “মুহাম্মাদের নেতৃত্বে ৩০০০ “পদাতিক সৈন্য নিয়ে মদিনাবাসী শহরে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সালমান আল-ফারসির পরামর্শ অনুযায়ী শহরের কিছু কৌশলগত স্থানে খন্দক (পরিখা) খনন করা হয়, যার ফলে এই যুদ্ধ খন্দকের যুদ্ধ নামে পরিচিতি লাভ করে। এক মাস ধরে চলা এই অবরোধ শেষ পর্যন্ত ঠান্ডা আবহাওয়া এবং ঝড়ের কারণে প্রত্যাহার করা হয়, যা মদিনাবাসীর বিজয় হিসেবে চিহ্নিত হয়।[২৫৯][২৬০]
খনন করা খন্দক, মদিনার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে মিলিত হয়ে, দুই পক্ষকে এক অচলাবস্থায় আটকে রাখে এবং বাহিনীর অশ্বারোহী ও উট-বহরকে অকার্যকর করে তোলে। মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজাকে শহরের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করার জন্য, অর্থাৎ মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার জন্য প্ররোচিত করে পৌত্তলিকরা। কুরাইজাদের এই পদক্ষেপ মদিনা চুক্তির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ চুক্তি অনুযায়ী, বাইরে থেকে মদিনা শহরে আক্রমণ হলে, শহরের সকল গোত্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে শহরকে একসাথে রক্ষা করবে। কিন্তু মুহাম্মাদের কূটনীতি এই ঐক্যকে ভেঙে ফেলে এবং মিত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। মুসলিমরা মাত্র ১-৫ জন হতাহতের শিকার হলেও, অপরপক্ষ হারায় ১০ জন সৈন্য।[২৫৬][২৫৭][২৫৮]
হুদাইবিয়ার সন্ধি
খন্দকের যুদ্ধের মানচিত্র |
মূল নিবন্ধ: হুদাইবিয়ার সন্ধি
নবী মুহাম্মাদ ও সাহাবীরা যখন কাবা জিয়ারতের জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, তখন মক্কাবাসী তাদের শহরে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। নিষিদ্ধ মাস চলমান থাকায় যুদ্ধও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তারা আপসের প্রস্তাব দেয়। ৬২৮ সালে হুদায়বিয়ায় উভয় পক্ষের মধ্যে ১০ বছরের জন্য যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।[২৬১] এই চুক্তির মূল বিষয়বস্তু ছিল-
১০ বছরের জন্য কোন পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না। এই সময়ের মধ্যে কেউ কারো জান ও মালের ক্ষতি করতে পারবে না। ঐ বছর মুসলমানরা কাবা জিয়ারত না করে ফিরে যাবে। পরের বছর মুসলমানরা তিন দিনের বেশি না থেকে কাবা জিয়ারত করতে পারবে।
হুদায়বিয়ার সন্ধি ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সন্ধি মুসলিমদের জন্য একটি বড় সাফল্য ছিল কারণ এটি ইসলামী রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান করে। এই সন্ধির ফলে মুসলিমদের মক্কা জয়ের পথও সুগম হয়।[২৬২]
হে স্রষ্টা! তোমার নামে। এটি মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ ও সুহাইল ইবন আমর-এর মধ্যে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি। তারা দশ বছরের জন্য অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়েছেন। উক্ত সময়ের মধ্যে উভয় পক্ষ নিরাপদ এবং কোন পক্ষই অপর পক্ষের ক্ষতিসাধন করবে না; কোন গোপন আক্রমণ করবে না, তবে তাদের মধ্যে পারস্পারিক সততা ও সম্মান বিরাজ করবে। আরবের যে কেউ যদি মুহাম্মাদের সাথে কোন চুক্তি করতে বা চুক্তিতে যোগ দিতে চায়, তবে সে তা করতে পারবে এবং যে কুরাইশের সাথে চুক্তি করতে বা চুক্তিতে প্রবেশ করতে চায়, সেও তা করতে পারবে। আর যদি কোন কুরাইশ অনুমতি ব্যতীত (মদিনায় প্রবেশ করে) মুহাম্মাদের নিকট উপস্থিত হয়, তবে তাকে কুরাইশের নিকট ফেরত দেওয়া হবে; তবে অন্যদিকে যদি মুহাম্মাদের লোকদের মধ্যে একজন কুরাইশের কাছে আসে তবে তাকে মুহাম্মাদের হাতে তুলে দেওয়া (ফেরত দেওয়া) হবে না। এ বছর মুহাম্মাদকে তার সঙ্গীদের নিয়ে মক্কা থেকে সরে যেতে হবে, তবে পরের বছর তিনি মক্কায় এসে তিন দিন অবস্থান করতে পারবেন, তবে তাদের অস্ত্র ব্যতীত এবং তরবারিগুলো খাপে বদ্ধ রেখে। ” |
— হুদাইবিয়ার সন্ধির বিবৃতি, [২৬৩] |
ইসলামে আমন্ত্রণপত্র
মূল নিবন্ধ: রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট মুহাম্মাদের প্রেরিত পত্রসমূহ |
হুদাইবিয়ার সন্ধি (৬২৮ খ্রিস্টাব্দ) সম্পন্ন হওয়ার পর, মুহাম্মাদ আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রের শাসকদের কাছে ইসলামে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠান। এই চিঠিগুলো ছিল ইসলামের বাণী বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই বিষয়ে কুরআনে বেশ কিছু আয়াত রয়েছে। যেমন:
বলুন, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রসূল, (“সেই আল্লাহর) “যিনি আকাশসমূহ আর পৃথিবীর রাজত্বের মালিক, “তিনি ছাড়া সত্যিকারের কোন ইলাহ নেই, “তিনিই জীবিত কড়েন আর মৃত্যু আনেন। কাজেই তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি ও তার প্রেরিত সেই উম্মী বার্তাবাহকের প্রতি যে নিজে আল্লাহর প্রতি ও তার যাবতীয় বাণীর প্রতি বিশ্বাস করে, তোমরা তার অনুসরণ কর যাতে তোমরা সঠিক পথ পেতে পার। “[সূরা আরাফ, আয়াত ১৫৮][২৬৪] |
হে রসূল! আপনার প্রতিপালকের নিকট থেকে যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার কর, যদি না কর তাহলে আপনি তার বার্তা পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করলে না। মানুষের অনিষ্ট হতে আল্লাহ্ই আপনাকে রক্ষা করবেন, আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে কক্ষনো সৎপথ প্রদর্শন করবেন না। [সূরা মায়িদাহ, আয়াত ৬৭][২৬৫] |
আমি আপনাকে সমগ্র মানবমন্ডলীর জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। [সূরা সাবা, আয়াত ২৮][২৬৬] |
ইসলামী ঐতিহ্য অনুসারে, মুহাম্মাদের মদিনা জীবনে অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের চিঠি পাঠানোর বেশ কিছু উদাহরণ রয়েছে। চিঠি প্রাপকদের মধ্যে রয়েছে পূর্ব রোমান (বাইজেন্টাইন) সম্রাট হেরাক্লিয়াস (৬১০-৬৪১), সাসানি সম্রাট দ্বিতীয় খসরু (৫৯০-৬২৮), আবিসিনিয়ার রাজা নাজাশি, মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার পিতৃপতি মুকাওকিস, সিরিয়ায় শাসনকারী আরব বংশোদ্ভূত খ্রিস্টান গাসানীরা, ইয়েমেন, ওমান, বাহরাইন সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসক।[২৬৭] এই চিঠিগুলোর সত্যতা নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও,[২৬৮] কতিপয় পক্ষ এগুলোকে “ভুয়া” বলে দাবি করলেও,[২৬৯] জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও ইসলামী সাহিত্যের অধ্যাপক ইরফান শহীদ মনে করেন যে মুহাম্মাদ কর্তৃক প্রেরিত এই চিঠিগুলোকে “ভুয়া” বলে উড়িয়ে দেওয়া “অন্যায়”। তিনি বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস (৬১০-৬৪১) কে লেখা চিঠিটির ঐতিহাসিকতা প্রমাণ করার জন্য সাম্প্রতিক গবেষণা উল্লেখ করেছেন।[২৭০]
ইসলামী ইতিহাস অনুসারে, ৬২৮ সালে, নবী মুহাম্মাদ বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে একটি চিঠি পাঠান। এই চিঠিতে তিনি সম্রাটকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানান। চিঠিটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য দাহিয়া কালবী নামে একজন সাহাবিকে দূত হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।[২৭১] ঐ সময়ে, সম্রাট হেরাক্লিয়াস সাসানির রাজা দ্বিতীয় খসরুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে জেরুজালেমে ধর্মীয় পরিদর্শনে ছিলেন।[২৭১] দাহিয়া কালবীর মূল দায়িত্ব ছিল চিঠিটি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বুসরা প্রদেশের গভর্নরের কাছে হস্তান্তর করা। কিন্তু সম্রাটের ফিলিস্তিনে উপস্থিতির খবর পেয়ে তাকে সম্রাটের সামনে উপস্থিত হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।[২৭২] ইতিহাসে বলা হয়েছে যে দাহিয়া কালবী সরাসরি সম্রাট হেরাক্লিয়াসের সাথে দেখা করেছিলেন। ঐ সময়ে, মক্কার কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ব্যবসার জন্য গাজায় অবস্থান করছিলেন। সম্রাটের আদেশে তিনিও এই সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন। হেরাক্লিয়াস নবী মুহাম্মাদ এর চিঠিটি সম্মানের সাথে গ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তিনি আরও জানতে আগ্রহী ছিলেন। তবে, তিনি স্পষ্টভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি। নবী মুহাম্মাদ এর বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে চিঠি পাঠানো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। এটি ইসলামের প্রসারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে নবী মুহাম্মাদ শুধুমাত্র আরবের একজন নেতা ছিলেন না, বরং তিনি একজন বিশ্ব নেতা হিসেবে তার ভূমিকা পালন করছিলেন।[২৭২] মুসলিম ঐতিহাসিকদের দ্বারা সংগ্রহ করা চিঠির নিম্নলিখিত অনুবাদ:
রহমান ও রহিম আল্লাহর নামে। আল্লাহর বান্দা ও রাসুল, মুহাম্মাদের পক্ষ হতে, রোমের সম্রাট হেরাক্লিয়াসের উদ্দেশ্যে… যারা হেদায়েতের পথ অনুসরণ করে তাদের জন্য সালাম! আমি আপনাকে ইসলামে দাওয়াত জানাচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, যাতে আপনি মুক্তি পেতে পারেন এবং আল্লাহ আপনাকে এর দ্বিগুণ প্রতিদান দেবেন। যদি আপনি আমার এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে আপনার সমস্ত প্রজার পাপ তোমার কাঁধে বইতে হবে। বল, ‘হে আহলে কিতাব! এমন এক কথার দিকে আসো, “যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই, তা এই যে, “আমরা আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো ‘ইবাদাত করব না এবং কোন কিছুকে তার শরীক করব না এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাদের মধ্যে কেউ কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করব না। “তারপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বলে দাও, তোমরা এ বিষয়ে সাক্ষী থাক যে, আমরা আত্মসমর্পণকারী। (সূরা আল-ইমরান, আয়াত ৬৪) — [২৭১][২৭৩] |
ইরফান শহীদ দাবি করেন যে, বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াসকে পাঠানো মুহাম্মাদের চিঠির চারপাশে তৈরি করা ইতিবাচক উপাখ্যানগুলো খুব কমই বিশ্বাসযোগ্য।[২৭০] অন্যদিকে, ইসলামী গবেষক মোহাম্মদ হামিদুল্লাহ এই চিঠির সত্যতা সমর্থন করেন এবং পরবর্তীতে একটি রচনায় মূল চিঠি বলে দাবি করা লেখাটিকে পুনর্গঠন করেন।[২৭৪]
এছাড়াও, এই চিঠিগুলো অন্যান্য শাসকদের কাছেও পাঠানো হয়েছিল। কিছু শাসক, যেমন মিশরের শাসক, এই চিঠিগুলোকে সহনশীলতার সাথে গ্রহণ করেছিলেন, অন্যদিকে সাসানি সাম্রাজ্যের শাসকের মতো কিছু শাসক সহিংসভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন।[২৬৭][২৭৫]
মক্কা বিজয়
মূল নিবন্ধ: মক্কা বিজয় |
হুদাইবিয়ার সন্ধি মক্কার কুরাইশদের একটি শাখা লঙ্ঘন করার পর, মুহাম্মাদ ১০,০০০ সৈন্যের একটি বিশাল মুসলিম বাহিনী গঠন করে মক্কা অবরোধ করেন। মক্কার নেতা আবু সুফিয়ান এরপর মুহাম্মাদের সাথে দেখা করে মুসলিম হওয়ার ঘোষণা দেন।[২৭৬] মুহাম্মাদ আবু সুফিয়ান সহ অনেক মক্কাবাসীকে আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দেন যারা তার বাড়িতে আশ্রয় নেবে। ঐ সময় মক্কায় অবস্থিত মুহাম্মাদের চাচা আব্বাসও মক্কাবাসীদের একই রকম কথা বলেন; তারা মসজিদুল হারামের ভেতরে বা তাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়।[২৭৬] মুসলিম বাহিনী চারদিক থেকে একই সাথে মক্কায় প্রবেশ করে।[২৭৭] ১১ জানুয়ারী ৬৩০ সালে, খুব অল্প সংখ্যক আক্রমণ ছাড়া রক্তপাতহীনভাবে মুসলিমরা মক্কা বিজয় করে। মক্কায় প্রবেশ করার সাথে সাথে মুহাম্মাদ আবু সুফিয়ানকে জানিয়ে কয়েকজন ব্যতীত অন্য কাউকে স্পর্শ করা হবে না বলে ঘোষণা করেন এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এরপর তিনি ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করে রাখা কাবার দিকে এগিয়ে যান। সূরা ইসরা-এর ৮১তম আয়াত পাঠ করে তিনি মূর্তিগুলোকে একের পর এক ভেঙে ফেলেন। বিলাল হাবেশী আযান দেন এবং এরপর মুহাম্মাদ তার সঙ্গী মুসলিমদের সাথে কাবা তাওয়াফ করেন। বিজয়ের পর কিছু মক্কাবাসী দলবদ্ধভাবে মুহাম্মাদের কাছে এসে মুসলিম হয়েছিল। মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম ধর্ম আরব উপদ্বীপে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে।[২৭৮]
মুহাম্মাদ এবং মুসলিম বাহিনীর মক্কা অভিমুখে অগ্রযাত্রা, সিয়ার-ই-নবী, আনুমানিক ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দ।
মক্কা বিজয়ের পর বিলাল ইবনে রাবাহ কাবার ছাদে দাড়িয়ে আযান দিচ্ছেন, সিয়ার-ই নবী।
মুহাম্মাদ মক্কা বিজয়ের পর কাবা ঘরে প্রবেশ করেন এবং সকল মূর্তি ধ্বংস করে দেন।
আরব বিজয়
মক্কা বিজয়ের পর, মুহাম্মাদ হাওয়াজিন গোত্রের মিত্রসংঘের সামরিক হুমকির সম্মুখীন হন। হাওয়াজিন ছিল মক্কার পুরোনো শত্রু এবং মক্কার প্রতিপত্তি হ্রাসের কারণে মক্কা বিরোধী নীতি গ্রহণ করে।[২৭৯] মুহাম্মাদ হুনাইনের যুদ্ধে হাওয়াজিন এবং সাকিফ গোত্রকে পরাজিত করেন।[২৮০]
একই বছর, মুহাম্মাদ উত্তর আরবে একটি অভিযান পরিচালনা করেন। মুতার যুদ্ধে পূর্ববর্তী পরাজয় এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা প্রদর্শনের অভিযোগের কারণে তিনি এই অভিযান চালান। তিনি ৩০,০০০ সৈন্য সমাবেশ করেন, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই দ্বিতীয় দিনে মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে অর্ধেক সৈন্যকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। মুহাম্মাদ তাবুক-এ শত্রু বাহিনীর সাথে যুদ্ধে না জড়ালেও, এই অঞ্চলের কিছু স্থানীয় নেতাদের আত্মসমর্পণ গ্রহণ করেন।[২৮০][২৮১]
পূর্ব আরবে অবশিষ্ট সকল মূর্তি ধ্বংস করার নির্দেশও তিনি দেন। পশ্চিম আরবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারী শেষ শহর ছিল তায়েফ। মুহাম্মাদ তাদের আত্মসমর্পণ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান যতক্ষণ না তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং পুরুষরা দেবী লাত-এর মূর্তি ধ্বংস করতে সম্মত হয়।[২৮২][২৮৩][২৮৪]
তাবুক যুদ্ধের এক বছর পর, বনু সাকিফ মুহাম্মাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে এবং ইসলাম গ্রহণ করতে দূত পাঠায়। অনেক বেদুঈন তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এবং যুদ্ধের লভ্যাংশ ভাগ করে নেওয়ার জন্য মুহাম্মাদের কাছে আনুগত্য স্বীকার করে। তবে, বেদুঈনরা ইসলামী ব্যবস্থার সাথে পরিচিত ছিল না এবং তারা তাদের স্বাধীনতা, অর্থাৎ তাদের নিজস্ব নীতিমালা এবং পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেয়েছিল। মুহাম্মাদের “মদিনার শাসন গ্রহণ করা, মুসলমান এবং তাদের মিত্রদের আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকা এবং মুসলমানদের ধর্মীয় কর যাকাত প্রদান করা”-এর জন্য একটি সামরিক ও রাজনৈতিক চুক্তির প্রয়োজন ছিল।[২৮৫]
বিদায়ী ভাষণ ও মৃত্যু
মূল নিবন্ধসমূহ: বিদায় হজ্জ ও বিদায় হজ্জের ভাষণ |
কিছু ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে, মুহাম্মাদকে বিষ প্রদান করে হত্যা করা হয়েছিল।[২৮৬] ৬২৯ সালে, খায়বারের বিজয়ের পর, খায়বারের এক ইহুদি নারী, যার নাম ছিলো জয়নব, তার নিহত আত্মীয়দের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুহাম্মাদকে বিষাক্ত খাসির মাংস পরিবেশন করে। মুহাম্মাদ প্রথম খাবার খাওয়ার সাথে সাথেই বুঝতে পারেন যে মাংসটি বিষাক্ত এবং তিনি তার সাহাবীদের সতর্ক করেন। তবে, সাহাবী বিশর ইবনে বেরা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। জয়নব পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে ক্ষমা পান, তবুও মুহাম্মাদ দীর্ঘদিন ধরে এই ঘটনার কারণে শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন।[২৮৭]
৬৩২ সালের মার্চ মাসে (৯ই জিলহজ্জ), মুহাম্মাদ তার বিদায়ী হজ্জ পালন করেন। এই হজ্জের সময়, তিনি আরাফাত পর্বতের রহমত পাহাড়ে ১০০,০০০ এরও বেশি মুসলমানের সমাবেশে ‘বিদায়ী ভাষণ’ প্রদান করেন। হজ্জ থেকে মদিনায় ফিরে আসার পর, মুহাম্মাদ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার জীবনের শেষ মুহূর্তে তার স্ত্রী আয়িশা এবং তার কন্যারা তার পাশে ছিলেন। বর্ণনা অনুসারে, তিনি মুসলিমদের উদ্দেশ্যে তার শেষ বাণীতে বলেছিলেন, “তোমাদের হাতে থাকা দাসদের প্রতি সদয় আচরণ করো, নামাজের প্রতি মনোযোগ দাও এবং নিয়মিত আদায় করো।”[২৮৮] তিনি আয়িশার কোলে মাথা রেখে শাহাদাহ পাঠ করেন। তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা শেষ বাক্যটি ছিল “আল্লাহুম্মা আর-রাফিকুল ‘আলা…” (যার অর্থ “সর্বোচ্চ বন্ধুর জন্য!”[২৮৯])। ৮ই জুন ৬৩২ “সালে মদিনায় মুহাম্মাদ শাহাদৎবরণ করেন।”[২৯০] তাকে মসজিদে নববীর পাশে, হযরত আয়িশার ঘরের পাশে সমাহিত করা হয়।
মুহাম্মাদ এর মৃত্যুর পর, সাহাবীরা নবীজির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু বকর-কে নতুন নেতা (খলিফা) হিসেবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন। মসজিদে নববীতে তার হাতে বায়’আত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করে তাকে প্রথম খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।[২৯১] কিছুদিন পর, বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ইরতিদাদ (ধর্মত্যাগ) এর ঘটনা ঘটতে থাকে। খলিফা আবু বকর সৈন্য নিয়ে এই বিদ্রোহী গোত্রগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালান এবং রিদ্দা যুদ্ধ নামে পরিচিত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়।[২৯২]
সমাধি
মূল নিবন্ধসমূহ: সবুজ গম্বুজ ও মকসজিদে নববী |
হযরত মুহাম্মাদকে যেখানে তার মৃত্যু হয়েছিল, তার স্ত্রী আয়েশার ঘরেই তাঁকে দাফন করা হয়।[২৯৩][২৯৪] উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ প্রথমের শাসনামলে মসজিদে নববী সম্প্রসারণ করা হয় এবং মুহাম্মাদের সমাধি (রওজা মোবারক) স্থানটিকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[২৯৫] ত্রয়োদশ শতকে মামলুক সুলতান মনসুর কালাউন নবী মুহাম্মাদের সমাধির উপর সবুজ গম্বুজটি নির্মাণ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ষোড়শ শতকে উসমানীয় সুলতান সুলতান সুলাইমান গম্বুজটির রঙ সবুজে পরিবর্তন করেন।[২৯৬] নবী মুহাম্মাদ এর কবরের ঠিক পাশে তার সাহাবী এবং প্রথম দুই খলিফা আবু বকর ও উমর ইবনুল খাত্তাব-কে দাফন করা হয়েছে।[২৯৩][২৯৭][২৯৮]
১৮০৫ সালে সৌদ বিন আবদুল-আজিজ মদিনা দখল করলে মুহাম্মাদের সমাধি থেকে সোনা ও রত্ন খচিত সাজসজ্জা সরিয়ে ফেলা হয়।[২৯৯] সৌদের অনুসারী ওয়াহাবিরা মদিনার প্রায় সকল গম্বুজ ভেঙ্গে দেয় (মুহাম্মাদের সমাধি গম্বুজ ব্যতীত) যাতে মানুষ সেগুলোর পূজা না করে।[২৯৯] সেই হামলায় নিছক ভাগ্যের জোরে নবী মুহাম্মাদ এর রওজা মোবারক রক্ষা পায়।[৩০০] ১৯২৫ সালে আবার যখন সৌদি মিলিশিয়ারা মদিনা পুনর্দখল করে, তখন তারা শহরটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়।[৩০১] ওয়াহাবি ইসলামি ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কবর চিহ্নিত না করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে।[৩০০] যদিও সৌদিরা এই রীতিটি অনুসরণ করে না, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক হাজী এই রীতি পালন করতে মদিনায় আসে এবং অনেক হাজী এখনও সমাধিতে আয়াত পাঠ করতে থাকেন।[৩০২]
অলৌকিকত্ব
মূল নিবন্ধ: মুহাম্মাদের অলৌকিক ঘটনাসমূহ |
মুহাম্মাদকে আদরিত করা বাক্যের সংখ্যার মতো, মুজিজা বা অলৌকিক ঘটনার সংখ্যাও শতাব্দী ধরে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সূরা ইসরা-এর ১ম আয়াতে উল্লেখিত ইসরা ও মিরাজ ঘটনাটি, যা সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে ঘটেনি, বাদ দিলে, কুরআনে সরাসরি মুহাম্মাদের ব্যক্তিগতভাবে করা কোন মুজিজার উল্লেখ নেই। তবে কিছু আয়াতের ব্যাখ্যা এবং হাদিস থেকে কিছু মুজিজার কথা জানা যায়।[৩০৩] বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হাদিসের বর্ণনা থেকে মুহাম্মাদের সাথে সম্পর্কিত প্রচুর সংখ্যক মুজিজার কথা জানা যায়। তবে, এসব হাদিস থেকে বর্ণিত অসংখ্য মুজিজার বর্ণনা কিছু ইসলামী গোষ্ঠী দ্বারা সন্দেহের সাথে দেখা হয়। অন্যদিকে, কিছু ইসলামী পণ্ডিত মনে করেন, মুহাম্মাদ অন্য নবীদের মতো স্পষ্ট মুজিজা দেখাননি, বরং তার একমাত্র মুজিজা হলো কুরআন, যা অনন্য এবং সকল ত্রুটি থেকে মুক্ত।[৩০৪]
জন্মের রাতের অলৌকিক ঘটনা
ইসলামী তথ্যসূত্র অনুসারে, মুহাম্মাদের জন্মের পূর্বে সূর্যোদয়ের আগে কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল: কা’বার বড় বড় মূর্তি নিজে থেকেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল; সাসানি সাম্রাজ্যের শাসক প্রথম খসরু পারস্যের রাজধানীতে অবস্থিত তার প্রাসাদের স্তম্ভগুলো ভেঙে পড়েছিল;” হাজার বছর ধরে জ্বলন্ত জরাথুস্ট্রীয়দের পবিত্র আগুন নিভে গিয়েছিল;” পারস্যের অগ্নিপূজারীদের পবিত্র মনে করা সাওয়া সরোবর মাটিতে ধসে গিয়েছিল; “শতাব্দী ধরে শুকনো সেমাওয়া সরোবর পানিতে ভরে উঠেছিল; সেই রাতে আকাশে একটি অত্যন্ত উজ্জ্বল নক্ষত্র উদিত হয়েছিল, এমনকি কিছু ইহুদি পণ্ডিত এই নক্ষত্রের মাধ্যমে মুহাম্মাদের জন্মের সংবাদ পেয়েছিলেন।[৩০৫][৩০৬]
চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনা
মূল নিবন্ধসমূহ: চন্দ্র বিভাজন ও সূরা আল-ক্বামার |
এক রাতে, মক্কার কিছু মূর্তিপূজক মুহাম্মাদের কাছে এসে তাকে চাঁদকে দুই ভাগ করার জন্য অনুরোধ করল। তারা বলেছিল যে যদি তিনি এটি করতে পারেন, তাহলে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে।[৩০৮] মুহাম্মাদ সারা রাত ভাবলেন এবং আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন। এরপর তিনি তার তর্জনী চাঁদের দিকে তুলে ধরলেন এবং চাঁদকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দিলেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চাঁদ দুই টুকরো হয়ে আকাশে ঝুলন্ত ছিল, তারপর আবার একত্রিত হয়ে গেল। এই অলৌকিক ঘটনাটি স্বচক্ষে দেখার পরও, মক্কার মূর্তিপূজকরা এটিকে জাদু বা বর্ম বলে অভিহিত করে মুহাম্মাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে অস্বীকৃতি জানায়।[৩১০]
পূর্ণিমা চাঁদ দুই টুকরো হয়ে, এক টুকরো মক্কার একটি পাহাড়ের পেছনে এবং অন্য টুকরো পাহাড়ের সামনে নেমে আসার পর আবার আকাশে মিলিত হওয়ার ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আলেম, হাদিস সমালোচক এবং ইসলামী দার্শনিকদের মধ্যে এই ঘটনার ব্যাখ্যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলে আসছে। কিছু গবেষক মনে করেন, এই ঘটনার বর্ণনা যে হাদিসগুলোতে পাওয়া যায়, সেগুলো দুর্বল, অবিশ্বস্ত এবং বানোয়াট।[৩১১][৩১২] অন্যদিকে, ইসলামী দার্শনিকদের মতামত হলো কুরআনের সূরা ক্বামার এর আয়াতগুলো রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ আসলে চাঁদ দুই টুকরো হওয়ার ঘটনাটি ঘটেনি। কিছু লোক মনে করেন, এটি একটি দৃষ্টিভ্রম ছিল। আবার কিছু তাফসিরকারী মনে করেন, আয়াতে বর্ণিত বিভাজনটি ভবিষ্যতে কিয়ামতের সময় ঘটবে।
ইসরা ও মিরাজের ঘটনা
মূল নিবন্ধসমূহ: লাইলাতুল মেরাজ ও সূরা ইসরা |
মুহাম্মাদেরহিজরতের দেড় বছর আগে ইসরা ও মিরাজের ঘটনা ঘটে বলে মনে করা হয়।[৩১৪] মুসলিমরা সাধারণত ইসরা কে মক্কা থেকে জেরুসালেম পর্যন্ত মুহাম্মাদের ভ্রমণ এবং মেরাজকে জেরুসালেম থেকে সপ্ত আসমান পর্যন্ত তার উর্ধ্বারোহণ হিসেবে বিশ্বাস করেন। এই ঘটনা অনুসারে, এক রাতে মুহাম্মাদ জিবরাঈল-এর সঙ্গে বোরাক নামক এক বাহনে চড়ে মসজিদুল আকসায় যান। সেখানে তিনি ইব্রাহিম, মুসা, ঈসা এবং অন্যান্য নবীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি সিদরাতুল মুনতাহা (সপ্তম আসমানের সর্বোচ্চ স্তর) পর্যন্ত আরোহণ করেন। সেখানে তিনি আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করেন, জান্নাত ও জাহান্নাম অবলোকন করেন এবং তারপর নিজগৃহে ফিরে আসেন। সুন্নি বিশ্বাস অনুযায়ী, এই ভ্রমণের সময়, অন্যান্য বিধানের পাশাপাশি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও মুসলমানদের জন্য ফরজ করা হয়েছিল। সুন্নি বিশ্বাস অনুযায়ী, মুহাম্মাদ এই ভ্রমণটি শরীর ও রুহ দিয়ে করেছিলেন। অন্যদিকে, শিয়া বিশ্বাস অনুযায়ী এই ভ্রমণ নবী মুহাম্মাদ শুধুমাত্র রুহ দিয়ে করেছিলেন।[৩১৫]
বর্ণনা অনুসারে, মুহাম্মাদ মেরাজ থেকে ফিরে এসে মক্কার লোকদের কাছে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তার বন্ধু আবু বকর তাকে বিশ্বাস করলেও, কুরাইশরা তাকে মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত করে। তারা তাকে যদি সত্যিই মেরাজে গিয়ে থাকেন তবে মসজিদুল আকসা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করতে বলেন। তখন আল্লাহর ইচ্ছায় মসজিদুল আকসার দৃশ্য মুহাম্মাদের চোখের সামনে এসে উপস্থাপিত হয়। তিনি মসজিদের দরজা, জানালা এবং অন্যান্য বিশদ বিবরণ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন। এমনকি, তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে কুরাইশদের বলেন যে, মিরাজের সময় তিনি যে কুরাইশি ব্যবসায়ীদের কাফেলা দেখেছিলেন, তারা পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে এসে পৌঁছাবে। কুরাইশিরা অবাক হয়ে দেখে যে, ঠিক মুহাম্মাদ যে সময় বলেছিলেন, ঠিক সেই সময়ই কাফেলাটি এসে পৌঁছায়। অন্য কিছু বর্ণনা অনুসারে, কাফেলাটি আসলে এক ঘন্টা দেরিতে পৌঁছানোর কথা ছিল। কিন্তু, আল্লাহ্ তাআলার বিশেষ ইচ্ছায় সূর্যোদয় এক ঘন্টা দেরিতে ঘটে এবং মুহাম্মাদের ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক প্রমাণিত হয়। এই ঘটনা মুহাম্মাদের নবুয়তের সত্যতার আরও একটি প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়। মেরাজের মাধ্যমে আল্লাহ তার প্রিয় নবীকে বিশেষ সম্মান এবং মর্যাদা দান করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়।[৩১৬]
কুরআনের সূরা ইসরা এর ১ম আয়াতে মেরাজের বিস্ময়কর ঘটনার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে-[৩১৭]
“পবিত্র ও মহীয়ান তিনি যিনি তার বান্দাকে রাতের বেলা ভ্রমণ করিয়েছেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত,” যার চারপাশকে আমি কল্যাণময় করেছি। তাকে আমার নিদর্শনাবলী দেখানোর জন্য, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা” |
— সূরা ইসরা, আয়াত ১ |
এই আয়াতটি মেরাজের ঘটনার বর্ণনা করে, যেখানে মুহাম্মাদকে এক রাতে মক্কার কাবা ঘর থেকে জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই অলৌকিক ভ্রমণে, তিনি আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শন দেখেছিলেন।[৩১৮]
মেরাজের বিবরণ হাদিস এবং সীরাতের বইগুলোতে পাওয়া যায়। বলা হয়েছে যে, মুহাম্মাদ ঘুমিয়ে ছিলেন এবং ফেরেশতা জিবরাঈল তাকে বোরাক নামক একটি উড়ন্ত জীবের উপরে করে আল-আকসা মসজিদে নিয়ে যান। সেখানে তিনি অনেক নবী-রাসুলের সাথে সালাত আদায় করেন। এরপর তাকে জান্নাত, জাহান্নাম এবং সিদরাতুল মুনতাহা দেখানো হয়। সিদরাতুল মুনতাহা হলো সপ্তম আকাশে একটি গাছ, যেখানে সৃষ্টির জ্ঞানের সীমা শেষ হয়।
ইসলামী বিশ্বে এই ঘটনার সাথে সম্পর্কিত সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হলো নবী মুহাম্মাদ কি এই ভ্রমণের সময় আল্লাহকে দেখেছিলেন। এই বিষয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। মুহাম্মাদের স্ত্রী আয়িশা এবং সাহাবী ইবন মাসউদ ও আবু হুরায়রার মতে, মুহাম্মাদ আল্লাহকে দেখেননি। তবে, ইবনে আব্বাস, আল-গাজ্জালি, আল-তাফতাজানি, ইমাম রব্বানি, আবু হানিফা, ইমাম আশআরি এবং সাইদ নুরসি এর মত বিখ্যাত ব্যক্তিরা মনে করেন যে মুহাম্মাদ মেরাজে আল্লাহকে দেখেছিলেন।[৩১৯]
এই ঘটনাগুলোর তারিখ নিয়েও বর্ণনাভেদ রয়েছে। ইবনে সাদের মতে, হিজরতের ১৮ মাস আগে রমজান মাসের ২৭ তারিখে কাবার কাছ থেকে মুহাম্মাদ সপ্ত আসমানে উন্নীত হন। অন্যদিকে, হিজরতের আগে রবিউস সানি মাসের ১৭ তারিখে মক্কা থেকে জেরুসালেম যাত্রাটি (ইসরা) সংঘটিত হয়।[৩২০] সুতরাং, পরবর্তীতে এই দুটি ঘটনাকে একীভূত করা হয়েছে। ইবনে হিশামের বিবরণ অনুসারে, প্রথমে ইসরা এবং তারপরে মেরাজের ঘটনা ঘটে। আবার তিনি এই ঘটনাগুলোকে হযরত খাদিজা এবং আবু তালিবের মৃত্যুর আগে ঘটেছিল বলে বর্ণনা করেছেন। বিপরীতে, আত-তাবারি, মুহাম্মাদের নবুয়তের শুরুর দিকে মক্কা থেকে ‘নিম্ন আসমানে’ আরোহণের বিবরণটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবন
বিবাহ ও সন্তান
মূল নিবন্ধসমূহ: মুহাম্মাদের স্ত্রীগণ ও আহল আল-বাইত |
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, মুহাম্মাদ ১১ জন স্ত্রীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন এবং তার দুইজন উপপত্নী ছিলেন।[৩২১] ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, রায়হানা বিনতে জায়েদ এবং মারিয়া আল-কিবতিয়া দু’জন ছিলেন উপপত্নী। মুহাম্মাদের দুটি বিবাহ মক্কায় এবং বাকি ১১টি বিবাহ মদিনায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল।[৩২২] মদিনায়, মসজিদে নববীর দেয়ালের সাথে সংযুক্ত ঘরগুলো তার স্ত্রীদের জন্য নির্মিত হয়েছিল। মুসলিমরা কুরআনের সূরা আহযাবের ৬নং আয়াতের ভিত্তিতে মুহাম্মাদের স্ত্রীদের “আমাদের মা” হিসেবে উল্লেখ করে। সূরা আহযাবে বলা হয়েছে,[৩২৩]
মুহাম্মাদ মু’মিনদের নিকট তাদের নিজেদের চেয়ে ঘনিষ্ঠ, “আর তার স্ত্রীগণ তাদের মাতা। “আল্লাহর বিধানে মু’মিন ও মুহাজিরদের (দ্বীনী সম্পর্ক) “অপেক্ষা আত্মীয়-স্বজনগণ পরস্পর পরস্পরের নিকট ঘনিষ্ঠতর। তবে তোমরা তোমাদের বন্ধু বান্ধবদের সাথে ভাল কিছু করতে চাও, করতে পার। (আল্লাহর) কিতাবে এটাই লিখিত। ” |
— সূরা আহযাব, আয়াত ৬ |
ইসলামী ব্যাখ্যা অনুসারে, মুহাম্মাদের একাধিক বিবাহের পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিবাহের মাধ্যমে বিভিন্ন কাবিলার মধ্যে বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা; যুদ্ধে পরাজিত শত্রুদের কন্যাদের সাথে বিবাহের মাধ্যমে তাদের ইসলাম গ্রহণে উৎসাহিত করা; বিভিন্ন কাবিলার সাথে বিবাহের মাধ্যমে রাষ্ট্রের অবস্থান ও শক্তি বৃদ্ধি করা; সুরক্ষাহীন নারীদের জীবনে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা প্রদান করা; বিভিন্ন ধর্মীয় বিধি ও রীতিনীতি ব্যক্তিগতভাবে অনুসরণ করে অন্যদের কাছে তা প্রদর্শন করা। কুরআনের সূরা আহযাব এর ৫০ ও ৫২ নম্বর আয়াত ও সূরা নিসার ৩ নম্বর আয়াতে একাধিক বিবাহের ব্যাপারে মুসলিমদের জন্য সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে।[৩২৪][৩২৫][৩২৬] এই আয়াতগুলো অনুসারে, একজন পুরুষ সর্বোচ্চ চারজন নারীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবেন। যখন এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়েছিল তখন মুহাম্মাদের চারজনের বেশি স্ত্রী ছিলেন। কুরআনের বিশেষ বিধান অনুসারে তার বিদ্যমান বিবাহগুলো বহাল থাকে, তবে নতুন করে আর বিবাহ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।[৩২৭]
বিখ্যাত ইসকটিশ ইতিহাসবিদ ও ধর্মতত্ত্ববিদ উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াট মনে করেন, মুহাম্মাদের সকল বিবাহ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ও জোরদার করার নীতির উপর ভিত্তি করে করা হয়েছিল এবং এগুলো সমসাময়িক আরব রীতিনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।[৩২৮]
মুহাম্মাদ এর চারিত্রিক মাধুর্য ও বিশ্বস্ততার কথা শুনে মক্কার সম্মানিত ব্যবসায়ী ধনী ও বিধবা খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ তাঁকে নিজের ব্যাবসায়িক প্রতিনিধি হিসেবে সিরিয়ায় পাঠানোর প্রস্তাব দেন।[৩২৯] মুহাম্মাদ প্রস্তাবে রাজি হলে নিজের ক্রীতদাস মাইসারাকেও তার সঙ্গে পাঠান। এ বাণিজ্যিক সফরে মুহাম্মাদ দ্বিগুণ মুনাফা অর্জন করেন। সফর থেকে ফেরার পর মুহাম্মাদের সততা, বিচক্ষণতা ও মাইসারার বর্ণনা শুনে খাদিজা তাঁকে বিয়ে করার মনস্থ করেন। মুহাম্মাদের কাছে বিবাহের প্রস্তাব দিলে তিনি সম্মত হন এবং চাচাদের তা অবগত করেন। মুহাম্মাদের চাচা হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব খাদিজা এর পরিবারের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যান। উভয় পরিবারের সম্মমিতে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিশুদ্ধ মতে বিয়ের সময় মুহাম্মাদ এর বয়স ২৫ বছর এবং খাদিজা-এর বয়স ৪০ বছর ছিল।[৩৩০] এই বিবাহ ২৫ বছর স্থায়ী হয় এবং এটি একটি সুখী দাম্পত্য জীবন ছিল। এই সময়ের মধ্যে মুহাম্মাদ অন্য কোন নারীকে বিবাহ করেননি। ৬১৯ সালে খাদিজা এর মৃত্যুর পর মুহাম্মাদ প্রায় ২.৫ বছর বিধব থাকেন।[৩৩১] এরপর সাহাবী উসমান ইবনে মাজউন এর স্ত্রী হাওলা বিনতে হাকিম মুহাম্মাদ কে সাবধানে ঘরের কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য সাহায্য করার উদ্দেশ্যে সাওদা বিনতে জামআ এর সাথে বিবাহের পরামর্শ দেন। সাওদা তার স্বামীর মৃত্যুর পর পাঁচ সন্তানকে নিয়ে একা ছিলেন। মুহাম্মাদ এই পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং ৬২১ সালে সাওদা এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।[৩৩২] তখন মুহাম্মাদের বয়স ছিল ৫০ বছর এবং সাওদা এর বয়সও মুহাম্মাদের এর চেয়ে বেশি, ৫০-এর কোঠায় ছিল বলে ধারণা করা হয়। ৬২৪ সালে মদিনায় হিজরত করার পর মুহাম্মাদ তার বাগদত্তা আয়িশা এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।[৩৩৩][৩৩৪] এর আগ পর্যন্ত, সাওদা তিন বছর ধরে মুহাম্মাদের একমাত্র স্ত্রী ছিলেন। মুহাম্মাদের একাধিক বিবাহের জীবন ৫৪ বছর বয়সে, ৬২৪ সালে আয়িশা এর সাথে বিবাহের পর শুরু হয়।[৩৩৪]
মুহাম্মাদ ও তার প্রথম স্ত্রী খাদিজা এর ঘরে মোট ৬ সন্তান ছিল।[৩৩৫][৩৩৬] এর মধ্যে কাসিম ও আব্দুল্লাহ নামের দুই পুত্র ছোটবেলায় মারা যান। আর চার কন্যার নাম ছিল জয়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম এবং ফাতিমা। মুহাম্মাদের “আবুল কাসেম” (কাসেমের পিতা) উপাধিটি তার প্রথম পুত্র কাসেমের নামের উপর ভিত্তি করে তৈরি। খাদিজার মৃত্যুর পর মুহাম্মাদের আরও বেশ কয়েকটি বিবাহ হয়েছিল।[৩৩৫] কিন্তু মারিয়া এর গর্ভজাত ইব্রাহিম ছাড়া অন্য স্ত্রীদের থেকে তার কোন সন্তান ছিল না। ইব্রাহিমও দুই বছর বয়সে মারা যায়।[৩৩৫]
ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে, আয়িশা যখন মুহাম্মাদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তখন তার বয়স ৬ বা ৭ বছর ছিল।[৩৩৭] তাদের বৈবাহিক জীবন শুরু হয় যখন আয়িশা ৯ বা ১০ বছর বয়সে পৌঁছান।[৩৩৩] ঐতিহ্যবাহী বর্ণনা অনুযায়ী, এই বিয়ের সময় আয়িশা কুমারী ছিলেন। তবে, আয়িশা এর বয়স নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান। কিছু আধুনিক মুসলিম লেখক আয়িশা এর বড় বোন আসমা এর সাথে বয়সের পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে হাদিসের ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের ধারণা অনুযায়ী, আয়িশা বিবাহের সময় ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ছিলেন। তুর্কি ইসলামি পণ্ডিত ইয়াশার নুরি ওজতুর্ক মনে করেন আয়েশা এর বয়স ছিল ১৭ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।[৩৩৮] তুর্কি ধর্মতত্ত্ববিদ ও সাবেক ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী সুলেমান আতেশ মনে করেন আয়িশা বিংশতির কোঠায় পা রাখার পর বিবাহিত হয়েছিলেন। ধর্মতত্ত্ববিদ আহমেদ তেকিন ও মুস্তাফা ইসলামোগলু আয়িশা এর বয়সের ব্যাপারে আরবি সংখ্যা ব্যবহারের রীতিনীতির উপর আলোকপাত করে বলেছেন যে, উল্লেখিত বয়স ১৬ এবং ১৯ বছর হিসেবে ব্যাখ্যা করা উচিত।[৩৩৯]
মুহাম্মাদের সবচেয়ে ছোট কন্যা ফাতিমা, ‘ফাতিমা আল-জোহরা’ নামেও পরিচিত, ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের একজন।[৩৪০] তিনি ছিলেন নবী মুহাম্মাদের একমাত্র কন্যা যার বংশধর টিকে ছিল এবং ইসলামের নবীবংশের ধারক। ফাতিমা আলেভি ও শিয়া মতাদর্শে বিশেষভাবে সম্মানিত এবং ‘দ্বিতীয় মরিয়ম’ হিসেবে পরিচিত।[৩৪১] ইসলামী রীতিনীতি অনুযায়ী, শরীফ ও সৈয়দদের বংশধারা ফাতিমা ও আলি এর মাধ্যমে মুহাম্মাদের সাথে সম্পর্কিত।[৩৪২]
মুহাম্মাদের মৃত্যুর পর তার নয়জন স্ত্রী বেঁচে ছিলেন এবং কেউই আর বিবাহ করেননি। কুরআনের সূরা আহযাব এর ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “পয়গম্বর মুমিনদের জন্য তাদের নিজেদের প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয়। তার স্ত্রীরা মুমিনদের মা।”[৩২৩] এই আয়াতের কারণে তাদের পুনর্বিবাহকে সমর্থন করা হয়নি এবং তারা বিবাহিত হননি।[৩৪৩]
সাক্ষরতা
মূল নিবন্ধ: উম্মি |
মুহাম্মাদের সাক্ষরতা বা পড়তে ও লিখতে পারার দক্ষতা সম্পর্কে ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিভঙ্গি হলো তিনি সাক্ষর ছিলেন না। মুহাম্মাদ এর জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত একটি বিশেষণ হলো “উম্মি”, যার একটি অর্থ হলো “যিনি জন্মগত অবস্থায় আছেন, যিনি পড়তে বা লিখতে শেখেননি”।[৩৪৪][৩৪৫] আরেকটি মতামত অনুযায়ী, “উম্মি” অর্থ “এমন একজন ব্যক্তি যিনি ‘আহলে কিতাব’ (ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বোঝায়) হিসেবে পরিচিত ধর্মসমূহের কোনো একটিরও অন্তর্ভুক্ত নন”।[৩৪৫]
মুহাম্মাদ লেখাপড়া জানতেন না এই ধারণাটি কুরআনের কিছু আয়াত এবং হাদিসের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। সূরা আনকাবূত এর ৪৮ নম্বর আয়াত এবং সূরা আরাফ এর ১৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে যে মুহাম্মাদ পূর্বে কোন বই পড়েননি এবং তিনি ছিলেন একজন “উম্মি”।[৩৪৬] এছাড়াও, জিবরাঈল যখন প্রথম ওহি নিয়ে আসেন তখন তিনি মুহাম্মাদ কে “পড়ুন” বলে নির্দেশ দেন এবং মুহাম্মাদ বলেন “আমি পড়তে জানি না”। সূরা জুমুআ এর ২ নম্বর আয়াতেও বলা হয়েছে যে মুহাম্মাদ নিরক্ষরদের নিকট রাসুল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন।[৩৪৭]
মুসলিমরা মনে করেন মুহাম্মাদ এর নিরক্ষরতাই প্রমাণ করে যে কুরআন তার রচনা হতে পারে না, বরং এটি ঐশ্বরিক উৎস থেকে এসেছে তার স্পষ্টতম প্রমাণ।
“ আপনি তো এর পূর্বে কোন কিতাব পাঠ করেননি, আর আপনি নিজ হাতে কোন কিতাব লেখেননি, এমন হলে মিথ্যাবাদীরা সন্দেহ পোষণ করত। ” |
— সূরা আনকাবূত, আয়াত ৪৮ |
কিছু বিকল্প মতামত অনুসারে, প্রাচীন আরবদের মধ্যে কবি, কাহিনীকার, হানিফ এবং ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মীয় পণ্ডিতদের সমন্বয়ে গঠিত একটি পুরনো ধর্মীয় জ্ঞানের ভাণ্ডার ছিল। সম্ভবত পৌরাণিক সংস্কৃতির জ্ঞানও সমাজের বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর কাছে পরিচিত ছিল। মুহাম্মাদ যে সমাজে বাস করতেন সেই সমাজও লিখিত বা মৌখিক বর্ণনার মাধ্যমে তৈরি জ্ঞানের ভাণ্ডারের অধিকারী ছিল বলে ধারণা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, মুহাম্মাদ এর প্রথম স্ত্রী খাদিজার চাচাতো ভাই ওয়ারাকাহ ইবনে নওফেল ছিলেন একজন খ্রিস্টান পাদ্রী। তিনি সিরীয় ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এবং তাওরাত, যাবুর ও ইঞ্জিল সম্বলিত কিতাব-ই-মুকাদ্দাসে জ্ঞানী ছিলেন। ধারণা করা হয় যে ওয়ারাকাহ তার কিছু ধর্মীয় জ্ঞান মুহাম্মাদ কে শিখিয়েছিলেন এবং এই জ্ঞানগুলোই কুরআনে ইহুদি ও খ্রিস্টান সংস্কৃতি সম্পর্কিত ধর্মীয় বর্ণনার উৎস হিসেবে কাজ করেছিল। এছাড়াও, দীর্ঘদিন ধরে একজন প্রভাবশালী ও ধনী মহিলা হিসেবে খাদিজার লেখাপড়া জানার বিষয়টিও ধারণা করা হয়।[৩৪৮] তবে, ইসলামী পণ্ডিত এবং কুরআন নিজেই এই দাবিগুলোর তীব্র বিরোধিতা করে।
অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক
মূল নিবন্ধসমূহ: ইহুদিদের প্রতি মুহাম্মাদের দৃষ্টিভঙ্গি, “বনু কুরাইজা অবরোধ ও মুহাম্মাদের সামরিক জীবন |
মক্কায় ধর্ম প্রচারের সময় মুহাম্মাদ খ্রিস্টান ও ইহুদিদের “আহলে কিতাব” হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তাদের ধর্মীয় শিক্ষার মূলনীতির সাথে ইসলামের মিল খুঁজে পেয়ে তিনি তাদেরকে স্বাভাবিক মিত্র মনে করেছিলেন এবং তাদের সমর্থন পাবেন বলে আশা করেছিলেন। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর তিনি মদিনার সনদ প্রণয়ন করেন যার আওতায় বনু কায়নুকা, বনু নাদির এবং বনু কুরাইজা সহ বিভিন্ন ইহুদি গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত ছিল।[৩৪৯]
হিজরতের পূর্বে ও পরে অনেক মদীনাবাসী মক্কার অভিবাসীদের বিশ্বাস গ্রহণ করে, কিন্তু অধিকাংশ ইহুদি ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের অস্বীকৃতির মূল কারণ ছিল মুহাম্মাদ কে পয়গম্বর (নবী) হিসেবে স্বীকার না করা। স্কটিশ ইতিহাসবিদ ও প্রাচ্যবিদ উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াটের মতে, ইহুদি ধর্মে একজন ইহুদি-নয় এমন ব্যক্তির পয়গম্বরত্ব স্বীকার করা সহজ ব্যাপার নয়।[৩৫০] আমেরিকান ইহুদি ইতিহাসবিদ মার্ক আর. কোহেনের মতে, মুহাম্মাদ এর বাণী ইহুদিদের কাছে অপরিচিত ছিল।[৩৫১] মুহাম্মাদ যদিও বলেছিলেন যে তার শিক্ষা পূর্ববর্তী পয়গম্বরদের শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, ওয়াটের মতে ইহুদিরা কুরআনকে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় গ্রন্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মনে করেনি।[৩৫০]
ঐতিহ্যবাহী সীরাত বর্ণনা অনুসারে আমরা জানতে পারি যে, পূর্বে বনু নাদির ও বনু কায়নুকা গোষ্ঠীকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এবং বনু কুরাইজা গোষ্ঠী চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগে অবরুদ্ধ হয়েছিল। এরপর বনু কুরাইজার পুরুষদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল এবং নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল এবং তাদের সম্পত্তি মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল।[৩৫২] এই বিষয়ে আমাদের জ্ঞান এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এই দাবিটি প্রথম উত্থাপন করেছিলেন ইহুদি বংশোদ্ভূত আরব ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক। ভারতীয় পণ্ডিত বারাকাত আহমদ তার মুহাম্মাদ অ্যান্ড দ্য জিউস: এ রি-এক্সামিনেশন (মুহাম্মাদ ও ইহুদিরা: পুনর্বিবেচনা) গ্রন্থে বলেছেন যে, মদিনায় ৬০০ থেকে ৯০০ মানুষের হত্যাকাণ্ড একটি গুরুতর বিপদ ডেকে আনতে পারত এবং প্রদত্ত সংখ্যাগুলো ইহুদি হিসাব অনুসারে মুহাম্মাদ এর পূর্বে সংঘটিত গণহত্যার উপর ভিত্তি করে তৈরি।[৩৫৩] বারাকাত আহমদ আরও বলেন যে, এই গোষ্ঠীগুলোর শুধুমাত্র একটি অংশকে হত্যা করা হয়েছিল এবং বাকিদের দাস হিসেবে বন্দি করা হয়েছিল।[৩৫৪][৩৫৫] ওয়ালিদ এন. আরফাত বলেছেন যে, ইবনে ইসহাক মুহাম্মাদ এর থেকে প্রায় ১০০ বছর পর এই ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং ইহুদি উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।[৩৫৬] আরফাত আরও উল্লেখ করেছেন যে, ইবনে ইসহাককে তার সমসাময়িক বিখ্যাত ইমাম মালিক ইবনে আনাস একজন নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদ হিসেবে বিবেচনা করেননি।[৩৫৬] এই বর্ণনাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন যে, এই ঘটনাগুলো বানানো বা অতিরঞ্জিত। তারা যুক্তি দেখান যে, ইবনে ইসহাক একজন নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদ ছিলেন না এবং তার বর্ণনাগুলো পক্ষপাতদুষ্ট। অন্যদিকে, কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন যে, এই ঘটনাগুলো সত্য এবং এগুলো ইসলামের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ঐতিহ্যবাহী সীরাত বর্ণনা অনুসারে মুহাম্মাদ এর সময়ে মদিনায় ইহুদি গোষ্ঠীগুলোর সাথে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল। এই ঘটনাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান এবং এগুলো সম্পর্কে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
ইসলামী অধ্যয়নের সংশোধনবাদী ধারা-এর মতো গবেষকরা এই কাহিনীগুলোর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। হাদিস ও সীরাতের উৎসগুলোতে মুহাম্মাদ এর জীবনের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন কাহিনীগুলো পরবর্তী সময়ে তার জীবনীতে সংযুক্ত করা হয়েছে বলে প্রায়শই বলা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে সম্পর্ক ইসলামের প্রাথমিক যুগে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল। ইহুদিদের “মুমিন” হিসেবে অভিহিত করা হত এবং তারা উম্মতের অংশ ছিল।[৩৫৭] উদাহরণস্বরূপ, মদিনার ইহুদি গোষ্ঠী বনু কুরাইজার হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা সহ কিছু ইহুদি-বিরোধী বর্ণনা মুহাম্মাদ এর অনেক পরে (১০০-১৫০ বছর পরে) ইসলামের ইহুদি ধর্ম থেকে পৃথক হওয়ার সময় তৈরি হয়েছিল।[৩৫৮]
ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত সুইস আইনজীবী সামি আলদীব এই বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন যে, খায়বারের যুদ্ধ এবং কুরাইজা গণহত্যার মতো ঘটনাগুলো ইহুদিদের ধর্মীয় গ্রন্থেও উল্লেখ রয়েছে, তবে এই উৎস অনুসারে, ইহুদিরা ইহুদি-নয় এমন ব্যক্তিদের হত্যা করেছিল।[৩৫৯] তুর্কি ধর্মতত্ত্ববিদ মুস্তাফা ইসলামোগলু মনে করেন যে, খ্রিস্টাব্দ ৭৩-৭৪ সালে ইসরায়েলের দক্ষিণে মাসাদায় রোমানদের হাত থেকে পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ইহুদিদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা, ইহুদি বংশোদ্ভূত ইবনে ইসহাক কর্তৃক “বনু কুরাইজা গণহত্যা” হিসেবে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে।[৩৬০][৩৬১] ইসলামোগলু মাসাদায় নিহত ইহুদিদের মোট সংখ্যা (৯১০-৯৫০ এর মধ্যে) মুহাম্মাদ এর উপর চাপিয়ে দেওয়া এই ঘটনায় মোট নিহত ইহুদির সংখ্যার সাথে তুলনা করে সমালোচনা করেছেন।[৩৬০]
মুহাম্মাদ মদিনায় তার ১০ বছরের জীবনে মক্কাবাসীদের সহ “বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রায় ১০০টি সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন”। এই অভিযানগুলো ছিল প্রতিরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক, অভিযানমূলক অথবা কেবলমাত্র মানসিক চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে। ইসলামী সাহিত্যে, মুহাম্মাদ যেসব অভিযানে স্বয়ং সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেগুলোকে “গাজওয়া” এবং যেসব অভিযানে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ না করে অন্য কাউকে সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন সেগুলোকে “সরিয়া” বলা হয়েছে।[৩৬২][৩৬৩]
চিত্রায়ন ও শারীরিক গঠন
মূল নিবন্ধ: মুহাম্মাদের প্রতিকৃতি |
মুহাম্মাদ এর চিত্রায়ন ইসলামে একটি বিতর্কিত বিষয়। মৌখিক ও লিখিত বর্ণনা সকল ইসলামী ঐতিহ্য দ্বারা সহজেই গ্রহণযোগ্য হলেও, চিত্রায়নের ক্ষেত্রে মতবিরোধ দেখা যায়।[৩৬৪] “কুরআন স্পষ্টভাবে মুহাম্মাদ এর ছবি আঁকা বা তৈরি করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে না। “তবে, কিছু হাদিস রয়েছে যেখানে মুসলিমদের মুহাম্মাদ এর চিত্র তৈরি করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে”।[৩৬৫] সকলেই একমত যে, মুহাম্মাদ এর চেহারার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কোনো প্রামাণিক চিত্রকলার ঐতিহ্য নেই। তবে, প্রাথমিক সীরাত গ্রন্থগুলোতে মুহাম্মাদ এর প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয়েছে এবং তার চেহারার বর্ণনা সম্পর্কে কিছু লিখিত বিবরণ রয়েছে যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য।
অনেক চিত্রকর্মে নবী মুহাম্মাদকে কেবলমাত্র তার মুখ সাদা রঙে ঢেকে রাখা অথবা আলোর শিখার মতো প্রতীকীভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। অন্যদিকে, বিশেষ করে ১৫০০ সালের পূর্বে নির্মিত চিত্রকর্মগুলোতে তার মুখও দেখানো হয়েছে।[৩৬৬][৩৬৭] বর্তমান ইরানে কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া,[৩৬৮] মুহাম্মাদ এর চিত্রায়ন বেশ বিরল এবং ইসলামের ইতিহাসে কোনও সম্প্রদায় বা যুগে এর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি।[৩৬৯][৩৭০] তবে, এটি প্রায়শই শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ফার্সি এবং অন্যান্য মিনিয়েচার চিত্রকর্মের বইগুলোতে দেখা যায়।[৩৭১] ইসলামে সাধারণ ধর্মীয় শিল্পের প্রধান হাতিয়ার অতীতেও এবং বর্তমানেও হলো ক্যালিওগ্রাফী। উসমানীয় সাম্রাজ্যে “হিলিয়া” শিল্পের বিকাশ ঘটে, যা মুহাম্মাদ এর সম্পর্কে লেখা বিষয়বস্তুকে সুন্দরভাবে চিত্রিত করার মাধ্যমে প্রকাশ করে।[৩৭০][৩৭১]
মুহাম্মাদ এর প্রাচীনতম চিত্রগুলো ১৩-শতকের আনাতোলীয় সেলজুক ও ইলখানিদ ইরানি ক্ষুদ্র চিত্রকর্মে (মিনিয়েচার) পাওয়া যায়। এগুলো সাধারণত সাহিত্যিক রচনায় ব্যবহৃত হতো যেখানে মুহাম্মাদ এর জীবন ও কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়েছে।[৩৭২] ইরানে যখন মঙ্গোল শাসকরা ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন ইসলামী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপনে সুন্নি ও শিয়া সম্প্রদায়গুলো মুহাম্মাদ এর ছবিসহ দৃশ্যমান চিত্রকলার ব্যবহার শুরু করে।[৩৭৩] মঙ্গোল অভিজাতদের ধর্মান্তরিত হওয়ার পূর্বে ইসলামি শিল্পে এমন বাস্তবধর্মী চিত্ররীতি চোখে পড়েনি। এর ফলে ইসলামের চিত্রকলায় বিমূর্ততা থেকে সরে আসার প্রবণতা তৈরি হয়। এসময়ে মসজিদ, কার্পেট, রেশম, সিরামিক এবং বইয়ের চিত্রায়নে, এমনকি কাচ এবং ধাতব শিল্পকর্মেও মানুষের চিত্রায়ন দেখা যায়।[৩৭৩] পারস্য অঞ্চলে, ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে ক্ষমতায় আসা সাফাভিদদের আগমনের আগ পর্যন্ত এই বাস্তবতাবাদী চিত্রণশৈলী অব্যাহত থাকে।[৩৭৩] শিয়া মতবাদকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণা করা সাফাভিদরা মুহাম্মাদ এর মুখমণ্ডল আলোর বলয় দিয়ে ঢেকে দিয়ে তার বৈশিষ্ট্যগুলো অস্পষ্ট করে দেয়। তার সত্তার দীপ্তি প্রকাশের জন্য তারা এই পদ্ধতি অবলম্বন করে।[৩৭৪] একইসাথে পূর্বেকার কিছু চিত্র বিকৃত করাও হয়।[৩৭৩] পরবর্তীতে উসমানীয় শাসনাধীন অঞ্চলসহ অন্যান্য এলাকাতেও চিত্র তৈরি অব্যাহত থাকে, কিন্তু মসজিদগুলো কখনোই মুহাম্মাদ এর ছবি দিয়ে সাজানো হতো না।[৩৭৫] ইলখানাত যুগ থেকে সাফাভিদ যুগ পর্যন্ত রাতের ভ্রমণ বা মেরাজের সচিত্র বর্ণনাগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।[৩৭৬] উনবিংশ-শতাব্দীতে ইরানে ছাপানো এবং সচিত্র মেরাজের বইয়ের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। কমিক বইয়ের কায়দায় নিরক্ষর জনগণ ও শিশুদের লক্ষ্য করে এগুলোতে মুহাম্মাদ এর মুখাবয়ব আবরণ দিয়ে দেখানো হত। মূলত ছাপাখানার আবির্ভাবের কল্যাণে এগুলো ছিল “ছাপানো পাণ্ডুলিপি”।[৩৭৬] বর্তমানে, বিশেষ করে তুরস্ক ও ইরানে, মুহাম্মাদ এর লক্ষ লক্ষ ঐতিহাসিক ও আধুনিক চিত্র রয়েছে। এগুলো পোস্টার, পোস্টকার্ড এমনকি কফি টেবিলসহ বই আকারেও প্রকাশিত হয়। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের অন্য অংশে এরকম চিত্র বিরল। অনেক দেশের মুসলিমরা এই ধরণের চিত্র সামনে পেলে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হতে পারেন।[৩৭২][৩৭৫]
ইবনে সাদ-এর “কিতাবুত-তাবাকাতুল-কবির” নামক গ্রন্থটি অন্যতম প্রাচীন উৎস, যেখানে মুহাম্মাদ এর শারীরিক বর্ণনার বহু মৌখিক চিত্র রয়েছে। মুহাম্মাদ এর চাচাতো ভাই এবং জামাতা আলীর বর্ণনা অনুসারে:[৩৭৭]
নবী মুহাম্মাদ বেশি দীর্ঘ কিংবা বেশি খাটো ছিলেন না”। তার হস্তদ্বয় ও পদদ্বয়ের তালু এবং আঙ্গুলসমূহ ছিল মাংসল”। তার মাথা ছিল কিছুটা বড় এবং হাত-পায়ের জোড়াগুলো ছিল মোটা”। বুক হতে নাভি পর্যন্ত পশমের একটি সরু রেখা প্রলম্বিত ছিল”। যখন পথ চলতেন মনে হতো যেন কোন উঁচু স্থান হতে নিচে অবতরণ করছেন। বর্ণনাকারী বলেন, তার পূর্বে কিংবা পরে আমি তার মতো (অনুপম আকর্ষণীয়”) আর কাউকে দেখিনি। ” |
আনাস ইবনে মালিক হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,[৩৭৮] |
নবী মুহাম্মাদ খুব দীর্ঘ ছিলেন না আবার খাটোও ছিলেন না”। তিনি ধবধবে সাদা কিংবা বাদামী বর্ণেরও ছিলেন না। তার চুল একেবারে কুঁকড়ানো ছিল না, আবার একদম সোজাও ছিল না। ৪০ বছর বয়সে আল্লাহ তা’আলা তাকে নবুওয়াত দান করেন। এরপর মক্কায় ১০ বছর এবং মদিনায় ১০ বছর কাটান। আল্লাহ তা’আলা ৬০ বছর বয়সে তাঁকে ওফাত দান করেন। ওফাতকালে তার মাথা ও দাড়ির ২০টি চুলও সাদা ছিল না। ” |
সাহাবি আবু হুরাইরাহ বর্ণনা করেছেন:[৩৭৯] |
নবী মুহাম্মাদ রুপো দিয়ে তৈরি যেন উজ্জ্বল সাদা ছিলেন; তার চুল হালকা ঢেউ খেলানো। তার কপাল প্রশস্ত ছিল এবং তার ভ্রু চাঁদের মতো, ঘন ছিল। তার দুই ভ্রুর মাঝখান উন্মুক্ত, বিশুদ্ধ রুপোর মতো। তার চোখ অত্যন্ত সুন্দর, মণি কালো। তার চোখের পাপড়ি এত ঘন ছিল যে একে অপরের সাথে স্পর্শ করত। যখন তিনি হাসতেন, তার দাঁত বজ্রপাতের মতো ঝলমল করত। তার দুই ঠোঁটও অতুলনীয় সুন্দর ছিল। তার দাড়ি ঘন ছিল। তার ঘাড় অত্যন্ত সুন্দর ছিল, না লম্বা না খাটো। তার ঘাড়ের সূর্য ও বাতাসে পোড়া অংশ সোনালী রুপোর ইব্রিকের মতো রুপোর সাদা ও সোনার লালচে ভাব ফুটিয়ে তুলত। তার বুক প্রশস্ত ছিল; তার বুকের সমতলতা আয়না ও সাদা চাঁদকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তার কাঁধ প্রশস্ত ছিল। তার হাত ও বাহু মোটা ছিল। তার হাতের তালু রেশমের চেয়েও নরম ছিল। |
ইসলামি পণ্ডিতদের বেশিরভাগই মতামত দিয়েছেন যে মুহাম্মাদ এর সাধারণত লম্বা চুল ছিল। তাদের মতে, তার চুলের দৈর্ঘ্য কানের লতি থেকে কাঁধের মধ্যে থাকত। এমনকি, তিনি মাঝে মাঝে তার চুল বেঁধে রাখতেন এবং বিনুনিও করতেন।[৩৮০] সাধারণভাবে জানা যায় যে মুহাম্মাদ এর চুল লম্বা ছিল, কখনো কখনো তিনি কাঁধ পর্যন্ত লম্বা করে রাখতেন, কখনো দুই ভাগ করে রাখতেন, আবার কখনো ধুলোবালি থেকে রক্ষা করার জন্য বা ভ্রমণে বের হওয়ার সময় বিনুনি করে রাখতেন।[৩৮১]
উত্তরাধিকার ও অনুসরণ
রিওয়ায়েত সংগ্রহ
মূল নিবন্ধসমূহ: হাদিস, সুন্নাহ ও হাদিস সমালোচনা |
মুহাম্মাদের বক্তব্য, কর্ম এবং আচরণকে হাদিস বলা হয় এবং এই হাদিস থেকে উদ্ভূত ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতিগুলোকে সুন্নাহ বলা হয়। প্রথম দিকে, এই হাদিসের সংখ্যা কয়েকশ বা কয়েক হাজার (প্রথম ১০০ বছরের মধ্যে ১০০০ টি) এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তবে তিন শতাব্দীর মধ্যে এই সংখ্যা লক্ষাধিকে পৌঁছেছে।[৩৮২]
শিয়া মুসলিমরা মুহাম্মাদের বক্তব্যের পাশাপাশি, তাদের ইমামদের (যাদেরকে তারা নির্দোষ বলে মনে করে) বক্তব্যকেও হাদিস হিসেবে গ্রহণ করে। অন্যদিকে, সুন্নিরা সমস্ত সাহাবিকে নির্ভরযোগ্য মনে করে, শিয়াদের মতে, সাহাবি এবং সাহাবিদের দেখা ব্যক্তিদের (তাবিয়ীন) একের পর এক বিশ্লেষণ করা হয় এবং ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় আলী বা আহলে বাইত-এর পক্ষে না থাকা বা তাদের বিরোধীদের মধ্যে থাকা ব্যক্তিদের নির্ভরযোগ্য বলে মনে করা হয় না এবং তাদের থেকে আসা রিওয়ায়েতগুলো প্রত্যাখ্যান করা হয়। সুন্নি হাদিস গ্রন্থগুলো মুহাম্মাদের মৃত্যুর ২০০-৩০০ বছর পরে এবং শিয়া হাদিস গ্রন্থগুলো ৪০০-৫০০ বছর পরে লেখা হয়েছিল।[৩৮৩] হাদিসকে কুরআনের পরে ইসলামের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়; তবে, ইতিহাসে এবং বর্তমানে, “অবিশ্বস্ত” হওয়ার কারণে হাদিস থেকে দূরে থাকা, অনেক হাদিসকে প্রত্যাখ্যান করা বা সমস্ত হাদিসকে প্রত্যাখ্যান করা মুসলিমও বিদ্যমান।
ইসলামী ঐতিহ্যে মুহাম্মাদের স্থান
আল্লাহর একত্ববাদ (ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়) প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের পর, মুহাম্মাদের নবুয়তের প্রতি বিশ্বাস ইসলামের মূল ভিত্তি। প্রত্যেক মুসলিম শাহাদত পাঠে ঘোষণা করে: “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল।” শাহাদত হলো ইসলামের মূল বিশ্বাস বা নীতি। ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, একজন নবজাতকের কানে শাহাদতই প্রথম পাঠ করা উচিত; শিশুদেরকে শাহাদত শেখানো হয় এবং মৃত্যুর সময় শাহাদত পাঠ করা হয়। মুসলিমরা নামাজের আহ্বানে (আযান) এবং নামাজে শাহাদত পুনরাবৃত্তি করে। ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে ইচ্ছুক অমুসলিমদেরকেও এই শাহাদত পাঠ করেই ইসলামে প্রবেশ করতে হয়।[৩৮৪]
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, মুহাম্মাদ হলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ রাসুল।[৩৮৫][৩৮৬] কুরআন স্পষ্টভাবে এই ধারণাকে নিশ্চিত করে। কুরআনে মোট চারবার মুহাম্মাদ নাম উল্লেখ রয়েছে এবং “সূরা মুহাম্মাদ” নামে আলাদা সূরাও অবতীর্ণ হয়েছে। কুরআনের সূরা আহযাব এর ৪০নং আয়াতে বলা হয়েছে,
মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যেকার কোন পুরুষের পিতা নয়, কিন্তু (সে) আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞাতা। ” |
— সূরা আহযাব, আয়াত ৪০ |
সূরা মুহাম্মাদ এর ২নং আয়াতে বলা হয়েছে,
আর যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আর” মুহাম্মাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে- কারন তা তাদের প্রতিপালকের প্রেরিত সত্য- তিনি তাদের মন্দ কাজগুলো মুছে দেবেন, আর তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটাবেন”। |
— সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত ২ |
সূরা আল-ইমরান এর ১৪৪নং আয়াতে বলা হয়েছে,
মুহাম্মাদ হচ্ছে একজন রসূল মাত্র, “তার পূর্বে আরও অনেক রসূল গত হয়েছে;” কাজেই যদি সে মারা যায় কিংবা নিহত হয়, তবে কি তোমড়া উল্টাদিকে ঘুরে দাঁড়াবে? “এবং যে ব্যক্তি উল্টাদিকে ফিরে দাঁড়ায় সে আল্লাহর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না এবং আল্লাহ কৃতজ্ঞদেরকে অতিশীঘ্র বিনিময় প্রদান করবেন। |
— সূরা আল-ইমরান, আয়াত ১৪৪ |
সূরা আল-ফাতহ এর ২৯নং আয়াত উল্লেখিত হয়েছে,
মুহাম্মাদ আল্লাহর রসুল। “আর যে সব লোক তার সঙ্গে আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর, নিজেদের পড়স্পরের প্রতি দয়াশীল। তাদেড়কে তুমি দেখবে রুকূ‘ “ও সাজদায় অবনত অবস্থায়, তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি অনুসন্ধানে নিয়োজিত”। তাদেড় চিহ্ন হল, তাদের মুখমণ্ডলে সেজদা্র প্রভাব পরিস্ফুট হয়ে আছে। তাদের এমন দৃষ্টান্তের কথা তাওরাতে আছে,” তাদের দৃষ্টান্ত ইঞ্জিলেও আছে। (তারা) “যেন একটা চারাগাছ তার কচিপাতা বের করে, তারপর তা শক্ত হয়, অতঃপর তা কান্ডের উপর মজবুত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়- যা চাষীকে আনন্দ দেয়। “(এভাবে আল্লাহ মু’মিনদেরকে দুর্বল অবস্থা থেকে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় ক’রে দেন) “যাতে কাফিরদের অন্তর গোস্বায় জ্বলে যায়। তাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনে আর সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। |
— সূরা আল-ফাতহ, আয়াত ২৯ |
মুসলিম ঐতিহ্য অনুসারে, নবী মুহাম্মাদের সাথে বিভিন্ন মুজিজা বা অলৌকিক ঘটনার সম্পর্ক জড়িয়ে আছে।[৩৮৭] এর মধ্যে রয়েছে চাঁদকে দুই ভাগ করা। অনেক মুসলিম ভাষ্যকার এবং কিছু পশ্চিমা পণ্ডিত কুরআনের সূরা ক্বামার এর ১-২নং আয়াতকে এইভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, যখন কুরাইশরা মুহাম্মাদের অনুসারীদের উপর নির্যাতন চালাতে শুরু করে, তখন তিনি তাদের সামনে চাঁদকে দুই ভাগ করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনাটি মুহাম্মাদের নবুয়তের প্রমাণ হিসেবে দেখা হয়।[৩৮৮][৩৮৯] তবে, পশ্চিমা ইসলামি ইতিহাসবিদ ডেনিস গ্রিল মনে করেন যে, কুরআনে স্পষ্টভাবে মুহাম্মাদের মুজিজা করার কথা বলা হয়নি। বরং, কুরআনকেই মুহাম্মাদের সর্বশ্রেষ্ঠ মুজিজা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি যুক্তি দেন যে, কুরআন একটি অলৌকিক বই যা মুহাম্মাদের উপর ঈশ্বরের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছিল। কুরআনের ভাষা, শৈলী এবং বিষয়বস্তু এতটাই অসাধারণ যে এটি মানুষের রচনা হতে পারে না।
ইসলামী ঐতিহ্য অনুসারে, মুহাম্মাদ যখন তায়েফের জনগণের কাছে ইসলামের প্রচার করতে গিয়েছিলেন, তখন তাকে তীব্র নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তায়েফের লোকেরা তাকে পাথর ছুঁড়ে এবং ধাওয়া করে তাকে শহর থেকে বের করে দিয়েছিল। এই ঘটনায় মুহাম্মাদ গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন এবং তার পায়ের রক্ত বয়ে চলেছিল। ঐতিহ্য আরও বর্ণনা করে যে, এই ঘটনার পর মুহাম্মাদ এর সাথে ফেরেশতা জিবরাঈল দেখা করেছিলেন এবং তায়েফের লোকদের উপর আল্লাহর আযাব নামানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জিবরাঈল বলেছিলেন, “আপনি যদি চান, তাহলে আমি এই পাহাড়ের দুই অংশ একত্রিত করে তাদের উপর চাপিয়ে দেব।” কিন্তু মুহাম্মাদ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং তায়েফের লোকদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও হেদায়েতের প্রার্থনা করেছিলেন।[৩৯০] তিনি বলেছিলেন, “না, আমি তাদের ধ্বংস চাই না। বরং আমি আশা করি তাদের বংশধরদের মধ্যে এমন লোক জন্মগ্রহণ করবে যারা আল্লাহ ও তার রাসূলে বিশ্বাস করবে।”
সুন্নাহ হলো নবী মুহাম্মাদ এর জীবন, কর্ম এবং উক্তির সমষ্টি। হাদিস নামে পরিচিত বর্ণনাগুলোতে এগুলো সংরক্ষিত আছে। ধর্মীয় রীতিনীতি, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, মৃতদেহের দাফন থেকে শুরু করে মানুষ ও আল্লাহর মধ্যকার ভালোবাসা, রহস্যময় বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত সহ বিস্তৃত কর্মকাণ্ড ও বিশ্বাসের সমাহার এতে অন্তর্ভুক্ত। ধার্মিক মুসলমানদের জন্য সুন্নাহ হলো অনুসরণের এক আদর্শ। এটি মুসলিম সংস্কৃতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। মুহাম্মাদ মুসলমানদের “আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক” (আরবী: السّلامُ عَلَيْكُمْ – আসসালামু আলাইকুম) বলে সালাম বিনিময় করতে শিখিয়েছিলেন, যা বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের নিয়মকানুন ও বিবরণ, রোজা এবং বার্ষিক হজ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি রীতিনীতির অনেক বিবরণ কুরআনে নয়, বরং কেবল সুন্নাতেই পাওয়া যায়।[৩৯১]
মুসলিমরা প্রথাগতভাবে বিভিন্ন উপায়ে মুহাম্মাদ এর প্রতি তাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করে আসছে। তার জীবন, শেফা’আত (পক্ষপাত) এবং মু’জিযা (মুজেজা)-র সাথে সম্পর্কিত ঘটনাগুলো জনপ্রিয় মুসলিম চিন্তাভাবনা ও কবিতাকে প্রভাবিত করেছে। মিশরীয় সুফি আল-বুসিরি (১২১১-১২৯৪)-এর মুহাম্মাদ এর প্রতি উৎসর্গীকৃত আরবি কবিতাগুলোর মধ্যে, কাসিদা-ই-বুরদা (“মান্টো কবিতা”) বিশেষভাবে পরিচিত এবং এর নিরাময়কারী, আধ্যাত্মিক শক্তি রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।[৩৯২] কুরআনে মুহাম্মাদকে “জগতের জন্য রহমত” হিসেবে উল্লেখ করে সূরা আম্বিয়ার ১০৭নং আয়াতে বলা হয়েছে,[৩৯৩][৩৯৪]
আর আমি তো আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি”। |
— সূরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭ |
পূর্বের দেশগুলোতে বৃষ্টির সাথে রহমতের সম্পর্ক স্থাপন, যেমন বৃষ্টি মৃতপ্রায় জমি কে পুনরুজ্জীবিত করে, তেমনি মুহাম্মাদকে একটি বৃষ্টির মেঘ হিসেবে কল্পনা করা হয় যা আশীর্বাদ বিতরণ করে, জমি ভেজায় এবং মৃত হৃদয়কে পুনরুজ্জীবিত করে (উদাহরণস্বরূপ, আল-লাতিফ)।[৩৯৪] মুহাম্মাদ এর জন্মদিন মুসলিম বিশ্বে একটি বড় উৎসব হিসেবে পালিত হয়, তবে ওয়াহাবি-প্রধান সৌদি আরব বাদ দিয়ে, যেখানে এই ধরনের উদযাপন উৎসাহিত করা হয় না।[৩৯৫] মুসলিমরা যখন মুহাম্মাদ এর নাম উল্লেখ করে বা লেখে, তখন তারা সাধারণত আরবি ভাষায় “صلى الله عليه وسلم” (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অভিব্যক্তিটি ব্যবহার করে যার অর্থ “আল্লাহ্ তাকে সম্মানিত করুন এবং তাকে শান্তি দান করুন”।[৩৯৬]
তাসাউফ
তাসাউফ বা ইসলামী আধ্যাত্মবাদ, ইসলামের প্রাথমিক যুগের শেষ দিক থেকে, বিশেষত প্রথম শতাব্দীর পরবর্তী সময় থেকে ইসলামী শরীয়াহ আইনের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।[৩৯৭] সুফি নামে পরিচিত ইসলামী মরমী সাধকগণ, যারা কুরআনের গূঢ় অর্থ এবং মুহাম্মাদ এর অভ্যন্তরীণ প্রকৃতি খুঁজতেন, তারা মুহাম্মাদকে শুধু একজন নবী হিসেবে নয়, একজন নিখুঁত মানুষ হিসেবেও দেখতেন। সকল সুফি আধ্যাত্মিক ধারা তাদের আধ্যাত্মিক উৎসকে মুহাম্মাদ পর্যন্ত নির্দেশ করে।[৩৯৮] ইসলামের সাথে সুফিবাদের গভীর যোগসূত্রের ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। সুফিগণ কুরআনকে বহির্মুখী ও অভ্যন্তরীণ অর্থের ধারক হিসেবে দেখেন এবং মুহাম্মাদকে এই অভ্যন্তরীণ জ্ঞানের মূর্ত প্রতীক মনে করেন। সমস্ত সুফি ধারা একমত যে, তাদের আধ্যাত্মিক পথের উৎস সরাসরি মুহাম্মাদ থেকে এসেছে।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
খ্রিস্টান ও ইউরোপীয় বিশ্ব
মূল নিবন্ধসমূহ: মুহাম্মাদের প্রতি মধ্যযুগীয় খ্রিস্টানদের দৃষ্টিভঙ্গি, মুহাম্মাদ ও খ্রিস্টান ও বাইবেলে মুহাম্মাদ |
মুহাম্মাদ সম্পর্কে ইউরোপের প্রাচীনতম ধারণাগুলো মূলত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত। এসময়ের কিছু ইহুদি ও খ্রিস্টান পণ্ডিত মুহাম্মাদকে (সাঃ) মিথ্যা নবী হিসেবে বিবেচনা করতেন। খ্রিস্টান দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাপ্ত এই ধারণাগুলো নবম শতাব্দীর থিওফেনস এবং সপ্তম শতাব্দীর সিরীয় লেখক জন বার পেনকায়ের মতো লেখকদের রচনায় পাওয়া যায়।
ইরানি অধ্যাপক সাইয়্যেদ হোসাইন নাসর এর মতে, মধ্যযুগীয় ইউরোপের সাহিত্য ও লেখালেখিতে মুহাম্মাদ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার প্রাধান্য ছিল। লাতিন ভাষাভাষী পণ্ডিতরা তাঁর জীবনী সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, কিন্তু তারা সেগুলোকে খ্রিস্টান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করতেন। এতে মুহাম্মাদকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হতো যিনি ইসলামের নামে মানুষকে প্রতারিত করে তাঁর অনুসারী বানিয়েছিলেন।
মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সাহিত্যে মুহাম্মাদকে কখনো কখনো মুসলমানদের পূজিত দেবতা বা মূর্তিপূজক ঈশ্বর হিসেবে চিত্রিত করা হতো। এই ধরণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীতে ইউরোপে ইসলামের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিল এবং খ্রিস্টান বিশ্বের মধ্যে ইসলামের প্রচলন ও মুহাম্মাদের প্রতি বিরোধিতা আরও শক্তিশালী করেছিল।
৬৩৫ সালে সিরীয় পাদ্রী প্রেসবিটার থমাস কর্তৃক লিখিত একটি ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, ৬৩৪ সালে রোমান সাম্রাজ্য এবং মুহাম্মাদের (সা.) নেতৃত্বাধীন আরব সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যেখানে আরবরা রোমানদের পরাজিত করে। ইতিহাসবিদরা এই যুদ্ধে “দাসিনের যুদ্ধ” হিসেবে অভিহিত করেন। এই নথিতে মুহাম্মাদের (সা.) আরবদের যুদ্ধজয় স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পরাজয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এর পূর্বে, ৬২৯ সালে, মুহাম্মাদের (সা.) প্রেরিত একটি মুসলিম বাহিনী সম্রাট হেরাক্লিয়াস কর্তৃক প্রেরিত একটি বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল, যা “মুতার যুদ্ধ” নামে পরিচিত। যদিও এই যুদ্ধে কোনো স্পষ্ট বিজয় নির্ধারিত হয়নি, মুসলিম বাহিনী পরাজিতও হয়নি।
৬৩৬ সালে লেখা একটি সিরীয় জার্নালে উল্লেখ করা হয়েছে যে মুহাম্মাদের (সা.) নেতৃত্বাধীন আরব সেনাবাহিনী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড দখল করেছে। জার্নালে বলা হয় যে আরবরা গালীল থেকে বাল্খ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে এবং বাইজেন্টাইন সৈন্যদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছে।
জার্নালটির তথ্য অনুযায়ী, “গাবিতা” নামক স্থানে ৬৩৬ সালে আরেকটি যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার কথা বলা হয়, যা ইয়ারমুক নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। বিখ্যাত জার্মান পণ্ডিত থিওডোর নোলডেকে উল্লেখ করেন যে এই যুদ্ধের তারিখ ও স্থান ইয়ারমুক যুদ্ধের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। খালিদ বিন ওয়ালিদ এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন, এবং এই যুদ্ধে মুসলিমরা গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করে, যা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের উপর তাদের আধিপত্য আরও শক্তিশালী করে।
মধ্যযুগে ইউরোপীয় সাহিত্য ও দার্শনিক চর্চায় মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হতে থাকে। ১৩শ শতাব্দীর ইতালীয় পণ্ডিত ব্রুনেত্তো লাতিনি তাঁর “Li livres dou tresor” গ্রন্থে মুহাম্মাদকে একজন প্রাক্তন রোমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসী এবং কার্ডিনাল হিসেবে চিত্রিত করেন। এই ধরনের চিত্রায়ন সেই সময়ে সাধারণ ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ছিল।
১৩০০-এর দশকে ইতালীয় কবি দান্তে তাঁর বিখ্যাত মহাকাব্য “ইনফার্নো”তে (দান্তের ইলাহি কমেডির অংশ), ২৮তম ক্যান্টোতে মুহাম্মাদ (সা.) এবং আলীকে ‘বিভেদ সৃষ্টিকারী ও ধর্মদ্রোহী’ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং তাদেরকে জাহান্নামের গভীর স্তরে অবস্থান করান, যেখানে শাস্তিস্বরূপ শয়তানেরা তাদের বারবার আঘাত করে। এই প্রতিক্রিয়া মধ্যযুগের ইউরোপীয় সাহিত্য এবং খ্রিস্টান দৃষ্টিভঙ্গিতে মুসলিম নেতাদের প্রতি বিরূপ ধারণার একটি উদাহরণ।
জার্মান দার্শনিক গটফ্রিড লাইবনিজ মুহাম্মাদকে (সা.) প্রশংসা করেন কারণ তিনি প্রাকৃতিক ধর্মের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি বলে মনে করতেন। লাইবনিজের মতে, মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন একজন সত্যনিষ্ঠ এবং ন্যায়পরায়ণ নেতা।
ফরাসি ইতিহাসবিদ হেনরি দে বোল্যাভিলিয়ার তাঁর “ভি দে মাহোমেদ” (মুহাম্মাদের জীবন) গ্রন্থে মুহাম্মাদকে (সা.) একজন দক্ষ রাজনৈতিক নেতা এবং ন্যায়পরায়ণ আইন প্রণেতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি তাঁকে ঈশ্বরের একজন রাসুল হিসেবে চিত্রিত করেন, যিনি ঈশ্বরের একত্ববাদের (তাওহীদ) বাণী ছড়িয়ে দিতে এবং পূর্বের খ্রিস্টানদের মধ্যে বিস্ময় তৈরি করতে এসেছিলেন। বোল্যাভিলিয়ার উল্লেখ করেন, মুহাম্মাদ (সা.) ধর্মের মাধ্যমে পূর্বকে রোমান ও পারস্যের শাসন থেকে মুক্ত করার একটি ঐশ্বরিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট মুহাম্মাদ (সা.) এবং ইসলামের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি মুহাম্মাদকে (সা.) একজন অনুকরণীয় আইন প্রণেতা ও মহান ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
রাশিয়ান লেখক লিও তলস্তয় তাঁর জীবনের শেষ দিকে মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যেখানে তিনি ইসলামের নবীর প্রতি তার শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন। তিনি মনে করতেন, মুহাম্মাদ (সা.) এবং ইসলাম ধর্ম খ্রিস্টধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তলস্তয়ের লেখায় মুহাম্মাদের (সা.) নীতিগুলি এবং ইসলামের শিক্ষার প্রতি তাঁর প্রশংসা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
আমেরিকান জ্যোতির্পদার্থবিদ মাইকেল এইচ. হার্ট ১৯৭৮ সালে “দ্য ১০০: এ র্যাঙ্কিং অফ দ্য মোস্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল পারসনস ইন হিস্ট্রি” বইটিতে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকা তৈরি করেন এবং তালিকার শীর্ষে নবী মুহাম্মাদকে (সা.) রাখেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক সমালোচনা ও বিতর্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে হার্ট তাঁর গবেষণালব্ধ প্রভাব মূল্যায়নকে প্রাধান্য দেন।
বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় শীর্ষে মুহাম্মাদকে স্থান দেয়ায় কিছু পাঠক হতবাক হতে পারেন, আবার অনেকেই এ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ইতিহাসে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ উভয় ক্ষেত্রেই অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছিলেন। |
আধুনিক ইতিহাসবিদ
আধুনিক ইতিহাসবিদ উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াট এবং রিচার্ড বেল মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে যে ধারণা প্রচলিত আছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাদের মতে, মুহাম্মাদ (সা.) ইচ্ছাকৃতভাবে তার অনুসারীদের প্রতারণা করেননি, বরং তিনি ছিলেন “নিঃসন্দেহে একজন সৎ ব্যক্তি” এবং তার কাজের উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ ভালো। তারা যুক্তি দেন যে, মুহাম্মাদ (সা.) তার দাবির পক্ষে যেকোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত ছিলেন, যা তার আন্তরিকতা এবং দৃঢ়তার প্রমাণ।
তবে, ওয়াট আরও বলেন যে, ভালো উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও তা সবসময় সঠিকতা এনে দেয় না। তিনি পরামর্শ দেন যে, “আধুনিক পরিভাষায় বলতে গেলে, মুহাম্মাদ সম্ভবত তার নিজস্ব অবচেতন মনকে ঐশ্বরিক বার্তার সঙ্গে মিশ্রিত করে ফেলেছিলেন।” উল্লেখ্য, উইলিয়াম এম. ওয়াট একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক হলেও তিনি মুহাম্মাদ (সা.) কে “ঈশ্বরের রাসুল” হিসেবে স্বীকার করেছেন।
মন্টগোমারি ওয়াট এবং ইতিহাসবিদ বারনার্ড লুইস মনে করেন, মুহাম্মাদকে (সা.) শুধুমাত্র একজন স্বার্থপর প্রতারক হিসেবে দেখা ইসলামের বিকাশ বোঝার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করবে। ইতিহাসবিদ আলফোর্ড টি. ওয়েলচ মনে করেন, মুহাম্মাদ (সা.) যে কাজটি করেছিলেন তার প্রতি অটুট বিশ্বাসের কারণে তিনি এতটা কার্যকর এবং সফল হতে পেরেছিলেন।
অন্যান্য ধর্ম
বাহাই ধর্মাবলম্বীরা মুহাম্মাদকে তাদের নবীদের একজন হিসেবে গণ্য করেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, মুহাম্মাদ ছিলেন নবীদের চক্রের শেষ নবী। তবে, বাহাই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বাহাউল্লাহর শিক্ষা মুহাম্মাদের শিক্ষার স্থান ও গুরুত্ব দখল করে নিয়েছে। বাহাই ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে, মুহাম্মাদের শিক্ষা এবং তাঁর নবুয়াতের মূল্য অনেক হলেও বাহাউল্লাহ তাঁকে পরিপূর্ণ করেছেন এবং মানবজাতির জন্য নতুন প্রেরণা প্রদান করেছেন। বাহাই ধর্মে নবী ও ধর্মীয় নেতা হিসাবে মুহাম্মাদের অবদানকে সম্মান জানানো হয়, তবে তাঁদের বিশ্বাস অনুযায়ী, বাহাউল্লাহর বার্তা সর্বশেষ ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
সমালোচনা
মূল নিবন্ধ: মুহাম্মাদের বিরুদ্ধ সমালোচনা |
মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা ৭ম শতাব্দী থেকেই শুরু হয়, যখন তিনি এক ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রচার করতে থাকেন। সেই সময়ের পৌত্তলিক আরবরা তাঁকে নিন্দা ও কটূ সমালোচনা করতে শুরু করে। আরবের ইহুদি গোষ্ঠী তাঁকে “হা-মেশুগা” (হিব্রু: מְשֻׁגָּע, “পাগল” বা “জ্বীনগ্রস্থ”) বলে ডেকেছিল, কারণ তাঁদের মতে তিনি তানাখের বর্ণনা ও ব্যক্তিত্বগুলোকে অনুসরণ করেছিলেন এবং ইহুদি বিশ্বাসকে “অবমূল্যায়িত” করেছেন। এছাড়াও, তাঁর অলৌকিক কাজ প্রদর্শনের অভাব এবং নিজেকে “শেষ নবী” ঘোষণা করার আগে তানাখে যিহোভার নির্বাচিত সত্যিকারের নবী ও মিথ্যা নবীদের মধ্যে পার্থক্য বোঝার জন্য বর্ণিত ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য প্রদর্শনের অভাব ছিল।
মধ্যযুগে, পশ্চিমা ও বাইজেন্টাইন খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ববিদরা মুহাম্মাদকে একজন বিপথগামী এবং দুঃখজনক মিথ্যা নবী হিসেবে উল্লেখ করেন। কিছু সমালোচক, যেমন টমাস আকুইনাস, মুহাম্মাদের পরকালে যৌন সুখের প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছেন।
ইসলাম, যা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম, দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচিত হয়ে আসছে। এসব সমালোচনা নবী মুহাম্মাদের নবুয়ত, নৈতিকতা, দাসপ্রথা, শত্রুদের প্রতি আচরণ, বৈবাহিক জীবন এবং ধর্মীয় বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির উপর কেন্দ্রীভূত হয়।
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে মুহাম্মাদ
চলচ্চিত্র
১৯৭৬ সালে সিরীয়-আমেরিকান পরিচালক মুস্তফা আক্কাদ পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটি “দ্য মেসেজ” নামে পরিচিত। এখানে মুহাম্মাদের মুখ বা শরীর কখনোই দেখানো হয়নি। পরিবর্তে, ইসলাম ধর্মের উত্থান ও বিস্তারের উপর ভিত্তি করে গল্পটি তৈরি করা হয়েছে। এটি সারা বিশ্বে সমাদৃত, বিশেষ করে এটির প্রথম দিকের একটি ইসলামিক চলচ্চিত্র হিসেবে। চলচ্চিত্রটির বেশিরভাগ দৃশ্য লিবিয়াতে এবং কিছু দৃশ্য মরক্কোতে ধারণ করা হয়েছিল, এবং এটি ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রটি হলো ইরানি পরিচালক মাজিদ মাজিদির “মুহাম্মাদ: দ্য ম্যাসেঞ্জার অব গড”, যা ২০১৫ সালে মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রে মুহাম্মাদের শৈশব, বিশেষ করে তার ১২ বছর বয়স পর্যন্ত সময়কাল তুলে ধরা হয়েছে। যদিও মুহাম্মাদের মুখ দেখানো হয়নি, তার শরীরের কিছু অংশ, যেমন হাত, পা এবং চুল দেখানো হয়েছে। প্রায় ৫-৬ বছর ধরে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর কিছু সমালোচকদের প্রশংসা পেলেও অনেকের কাছ থেকে সমালোচনা এবং বিতর্কের মুখে পড়ে। বিশেষ করে কিছু সুন্নি মুসলিম মাজিদিকে শিয়া দৃষ্টিকোণ থেকে সিনেমা তৈরি করার অভিযোগ আনেন, তবে মাজিদি এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।
সাহিত্য
মুহাম্মাদের জীবন নিয়ে বাংলা ও মুসলিম বিশ্বের বহু লেখক অসংখ্য সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন।
বিশ্ববিখ্যাত রুশ লেখক লিও টলস্টয় তার জীবনের শেষ বছরগুলোতে মুহাম্মাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তার কিছু উক্তি (হাদিস) সংগ্রহ করেন এবং একটি বই আকারে প্রকাশ করেন, যা মুহাম্মাদ সম্পর্কে তার ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে।
এছাড়া, আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও লেখক মাইকেল এইচ. হার্ট তার ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত “দ্য ১০০: এ র্যাংকিং অব দ্য মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল পিপল ইন হিস্ট্রি” বইতে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকা করেছেন। তার এই তালিকার প্রথম স্থানেই মুহাম্মাদকে রাখা হয়, যা অনেকের দ্বারা প্রশংসিত এবং কিছু ক্ষেত্রে বিতর্কিতও হয়েছিল।
সঙ্গীত
মুহাম্মাদ এবং ইসলাম ধর্মকে কেন্দ্র করে রচিত সঙ্গীতের ক্ষেত্রে লেবাননের বংশোদ্ভূত সুইডিশ সঙ্গীতশিল্পী মেহের জেইন এর গানগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ও অন্যতম জনপ্রিয়। ২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “ইয়া নাবী সালাম আলাইকা” (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, হে পয়গম্বর) এবং ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম” (মুহাম্মাদ, আল্লাহর শান্তি ও আশীর্বাদ তার উপর বর্ষিত হোক) গানগুলো এর উদাহরণ।
আরও দেখুন
পাদটীকা
মুহাম্মাদের পূর্ণ নাম ছিল আবুল কাসিম মুহাম্মাদ ইবনে ʿআবদুল্লাহ ইবনে ʿআবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম (ابو القاسم محمد ابن عبد الله ابن عبد المطلب ابن هاشم)। প্রভাবশালী ইসলামী রীতি অনুযায়ী, তার মৃত্যুর দিনটি ৮ জুন, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ বলে চিহ্নিত। কিছু অ-ইসলামী রীতি তাকে মুসলিমদের ফিলিস্তিন বিজয়ের সময়ও জীবিত হিসেবে উল্লেখ করেছে।
ওয়েলচ, মুসালি এবং নিউবির মতে, ইসলামের নবী ছিলেন একজন ধর্মীয়, রাজনৈতিক, ও সামাজিক সংস্কারক, যিনি একটি মহান সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। আধুনিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচিত, তবে ইসলামী বিশ্বাস মতে, তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল, আরবদের জন্য এবং পরবর্তীতে সমগ্র মানবজাতির জন্য “সতর্ককারী” হিসেবে প্রেরিত।