গিবত:
গিবত, অর্থাৎ অন্যের পেছনে তার দোষ নিয়ে আলোচনা করা, পরনিন্দা বা কুৎসা রটানো, ইসলামের দৃষ্টিতে একটি মারাত্মক পাপ হিসেবে বিবেচিত। এই কাজকে ইসলামে কবিরা গুনাহ বা গুরুতর পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে কঠোর সতর্কতা দেওয়া হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে গিবত করা হারাম এবং এটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
হাদিসে বর্ণিত আছে যে, যারা মানুষের সামনে ও পেছনে তাদের দোষ তুলে ধরে বা সমালোচনা করে, তাদের জন্য ধ্বংসের দুঃসংবাদ রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যারা অগ্র-পশ্চাতে অন্যের দোষ বলে বেড়ায়, তাদের জন্য রয়েছে ধ্বংসের দুঃসংবাদ।’ (মুসলিম)।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আর তোমরা অন্যের দোষ খুঁজে বেড়াবে না।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১২)। আরও বলা হয়েছে, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে। নিশ্চয়ই তারা হুতামাতে (জাহান্নামে). নিক্ষিপ্ত হবে। তুমি কি জানো হুতামা কী? তা আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি,. যা হৃদয়কে গ্রাস করবে। এটি বেষ্টন করে রাখবে দীর্ঘায়িত স্তম্ভসমূহে।’”(সুরা হুমাজা, আয়াত: ১-৯”)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘তোমরা কি জানো গিবত কাকে বলে?’ সাহাবিরা উত্তরে বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) ভালো জানেন।’ তখন তিনি বলেন, ‘তোমার কোনো ভাই সম্পর্কে এমন কিছু বলা, যা সে অপছন্দ করে, তাই গিবত।’ সাহাবায়ে কেরাম আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, যদি আমি যে দোষের কথা বলি, তা তার মধ্যে থাকে, তাহলেও কি এটি গিবত হবে?’ উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি তুমি সেই দোষের কথা বলো এবং তা তার মধ্যে থাকে, তবে তুমি অবশ্যই গিবত করছ, “আর যদি তা তার মধ্যে না থাকে, “তবে তুমি তার উপড় মিথ্যা অপবাদ বা বুহতান আরোপ করছ।’ (মুসলিম)।
মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার পরিণাম ইসলামে অত্যন্ত কঠোর। শরিয়তের দণ্ডবিধি অনুযায়ী, কেউ যদি অন্যের ওপর মিথ্যা অপবাদ দেয়, তবে তার জন্য শাস্তি নির্ধারিত আছে। ইসলামি দণ্ডবিধি অনুযায়ী, এমন ব্যক্তির জন্য রয়েছে ৮০ দোররা (চাবুক) মারার শাস্তি। এরা ফাসিক বা পাপী হিসেবে বিবেচিত, এবং শরিয়তের আদালতে তাদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।
মদ্যপান, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার ইত্যাদি থেকেও মারাত্মক ও নিকৃষ্টতম পাপ ও কবিরা গুনাহ হলো গিবত। অন্যান্য পাপ তওবা দ্বারা মাফ হয়; গিবতকারীর পাপ শুধু তওবা দ্বারা মাফ হয় না, যার গিবত করা হয়েছে সে ব্যক্তি যদি মাফ করে, তবেই আল্লাহর কাছে মাফ পাওয়া যেতে পারে
গিবত বা পরনিন্দা ইসলামে সম্পূর্ণভাবে হারাম এবং নিষিদ্ধ। গিবত করা যেমন অপরাধ, তেমনই গিবত শোনাও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ইসলামি শরিয়তে এটি এতটাই গুরুতর পাপ যে, অনেকেই এটি পাপ হিসেবে না দেখে সাধারণ বিষয় বলে মনে করেন। কিন্তু গিবত এমন একটি কবিরা গুনাহ, যা মদ্যপান, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার প্রভৃতি থেকে আরও মারাত্মক।
ইসলামি বিধানে অন্যান্য পাপ তওবার মাধ্যমে ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ থাকলেও, গিবতের ক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে মাফ পাওয়ার জন্য তওবার পাশাপাশি যার গিবত করা হয়েছে, তার ক্ষমাও প্রয়োজন। অর্থাৎ, গিবতের শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে শুধু আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা যথেষ্ট নয়, বরং যার বিরুদ্ধে গিবত করা হয়েছে তার কাছেও ক্ষমা চাওয়া জরুরি। এ কারণে ইসলামি বিধানে গিবতকে কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়েছে।
যখন কেউ আপনার সামনে অন্যের গিবত করে, তখন তাকে সতর্ক করুন এবং আল্লাহর নির্দেশনার কথা স্মরণ করিয়ে দিন। যদি তাতেও কাজ না হয়, তবে সেই স্থান থেকে সরে আসুন.। মহানবী (সা.) বলেছেন, “পরনিন্দাকারি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না” (,বুখারি ও মুসলিম)।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মিরাজের ঘটনা বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যখন আমাকে মিরাজে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন আমি তামার নখবিশিষ্ট একদল লোক দেখলাম, যারা তাদের মুখমণ্ডল ও বুক আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরাইল! এরা কারা?’ জিবরাইল (আ.) বললেন, এরা সেই লোক, যারা দুনিয়াতে মানুষের গিবত করত ও তাদের মানহানি করত” (আবু দাউদ)।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি দুনিয়াতে তার ভাইয়ের গিবত করবে, কিয়ামতের দিন তাকে পচা মাংস খেতে বাধ্য করা হবে। তখন সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চিৎকার করতে করতে তা ভক্ষণ করবে।” (বুখারি)
সাহাবিরা একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “হে আল্লাহর রাসুল! গিবত কি জেনার চেয়েও মারাত্মক?” জবাবে তিনি বললেন, “হ্যাঁ। কারণ, কেউ জেনার পর তওবা কড়লে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন”। কিন্তু গিবতকারীর ক্ষেত্রে,. যার গিবত করা হয়েছে, সেই ব্যক্তি তাকে মাফ না কড়লে আল্লাহও মাফ করবেন না।” (মুসলিম)
হাদিসে গিবতের কাফফারাও উল্লেখ করা হয়েছে: “তুমি যার গিবত করেছ, তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করো। বলো, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার এবং তার গুনাহ মাফ করে দাও”।” (বায়হাকি)
গিবতের বিষয়ে ইসলাম নির্দেশ দেয়, সংশোধনের জন্য কিছু বলতে চাইলে তা শুধু সেই ব্যক্তিকে বলবে, অন্যকে নয়। বিচার দিবসে সমালোচনাকারীকে নিজের নেক আমল দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে হবে, এবং যার সমালোচনা করা হয়েছে তার পাপ নিতে হবে, যা জাহান্নামের কারণ হতে পারে।
ওকে